স্টাফ রিপোর্টার।
অতি বৃষ্টি, নদী ভাঙন, লবণাক্ত ও জলাবদ্ধতায় নাকাল খুলনা উপকূলের কৃষিজীবীরা। সর্বশেষ টানা বর্ষণে শুধু খুলনায়ই ফসল, সবজি ও আমনের বীজতলা নষ্ট হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১৩ সহস্রাধিক কৃষক। এমন সময়ে অতিবৃষ্টি ও জলাবদ্ধতা মোকাবেলায় চলতি আমন মৌসুমে ভাসমান ধানের বীজতলা তৈরিতে সফলতা পেয়েছেন খুলনার এক কৃষক পরিবার। চলতি বর্ষা মৌসুমে সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাতে কয়েক দফা বীজতলা নষ্ট হওয়ার এ ব্যতিক্রম উদ্যোগ নিয়ে অনেকটাই সফল হয়েছেন পাইকগাছা উপজেলার নোয়াকাটি গ্রামের কৃষক রোকেয়া পারভীনের। এমন অবস্থায় দেবর আব্দুল কুদ্দুসকে নিয়ে ফেলে দেওয়া কলাগাছ, বাঁশ, মাটি ব্যবহার করে তৈরী বীজতলা এখন দুযোর্গ কবলিত কৃষকদের আশার আলো দেখাচ্ছে।
কৃষক রোকেয়া পারভীন বলেন, বৃষ্টির জন্য কয়েক দফায় প্রায় ১০০কেজি বীজ ধান নষ্ট হয়ে গেছে। কোন কুল-কিনারা পাচ্ছিলাম না, অ্যাওসেড’র কৃষি কর্মকর্তাদের পরামর্শে কলা গাছের ভেলা বানিয়ে কাদমাটি তুলে ব্রি-৭৫ আমন ধানের বীজ ফেলছি। একটি বীজও নষ্ট হয়নি। বরং মাত্র ১৫দিনে চারা রোপণের মতো হয়েছে। এখন আশেপাশের কৃষকরা আগ্রহ দেখাচ্ছেন। এ বছর দেরী আমন রোপনে দেরী হয়েছে; সামনে আর সমস্যা হবে না। দুর্যোগের জন্য আর বীজতলা তৈরীর জন্য বসে থাকতে হবে না।
রোকেয়ার দেবর আব্দুল কুদ্দুস বলেন, ১২-১৩ বছর আগে ভাই আবুল মোড়লের মৃত্যুর পর ভাবী (রোকেয়া ) সার্বক্ষণিক আমাদের কৃষিকাজে উৎসাহ দেন। কলা গাছের ভেলার বীজতলার কথা শুনে তিনি সবকিছু গুছিয়ে দেন। প্রথমে আমাদের কাজ দেখে প্রথমে সবাই পাগল বলতো। বলতো কলা গাছের ভেলায় ধান হলেতো কারো জমি দরকার ছিলনা। কিন্তু এখন সবাই অবাক। এখানে কোন সার-কীটনাশকও লাগেনি। জমিতেও এমন ধানের চারা আর কখনো হয়নি। শুধু আমরা না, গ্রামের সবাই খুশী।
সোয়াকাটি গ্রামের কৃষক কবির মোড়ল বলেন, মাত্র ১০দিনে ৩/৪ ইঞ্চি ধানের চারা! বিশ্বাসই হচ্ছে না। অথচ আমার বীজতলা নষ্ট হয়ে গেছে।
কৃষক আব্দুল্লাহ মোড়ল জানান, চলতি আমন মৌসুম বৃষ্টির কারণে একমাস দেরী হয়েছে। সামনে আর সমস্যা হবেনা। কলার ভেলা বা প্লাস্টিকের ড্রামের মাধ্যমে মাচা তৈরি করে ধানের বীজতলা করা যাবে। এতে সার-কীটনাশকের ব্যবহার করতে হচ্ছে না। এই পদ্ধতির বিভিন্নস্থানে ছড়িয়ে দিলে কৃষক উপকার পাবে।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অটোক্রোপ কর্মকর্তা রুহুল আমিন বিষ্ময় প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, কলা গাছের ভেলায় ধানের বীজতলা কৃষকদের স্বপ্ন দেখাবে।ভাসমান ভেলায় ধানের বীজতলা তৈরিতে প্রত্যক্ষভাবে কাজ করেছেন অ্যাওসেড’র কমিউনিটি মোবালাইজার শুভঙ্কর বিশ্বাস নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, ২০ বছরের মধ্যে এ বছর সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হয়েছে। এতে পাইকগাছাসহ খুলনা অঞ্চলে আমনের বীজতলা কয়েক বার নষ্ট হয়ে যায়। এ অবস্থা থেকে ভাসমান বীজতলা তৈরির বিষয়টির ভাবনা, যা কৃষকরা সফল বাস্তবায়ন করেছেন। আগামী দিনে ভাসমান ভেলা জলাবদ্ধতা অঞ্চলের মানুষের স্বপ্ন দেখাবে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এ বছর ৫ জুলাই থেকে ১৪ জুলাই পর্যন্ত টানা বৃষ্টির কারণে সৃষ্ট জলাবদ্ধতায় ৫৭৫ হেক্টর বীজতলার মধ্যে ১০৬ হেক্টর আমন বীজতলা নষ্ট হয়েছে। এর মধ্যে ৫৩ হেক্টর জমিই পাইকগাছায়। খুলনায় ২০.৮৭০ হেক্টর ফসলের মধ্যে সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৮৪৮ হেক্টর। ১৩ হাজার ৭১ জন কৃষকের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ২৭ কোটি ৬৫ লাখ ৯৭ হাজার টাকা।পাইকগাছা ক্লাইমেট জার্স্টিস ফোরামের সভাপতি অধ্যক্ষ রমেন্দ্র নাথ সরকার বলেন, আমি ভাসমান বীজতলাটি দেখেছি। বৈশ্বিক জলবায়ূ পরিবর্তন মোকাবেলায় আমাদের কৃষক দম্পত্তির এমন উদ্যোগ নি:সন্দেহে আশাব্যাঞ্জক। তাদের এ সফলতা শুধু খুলনায়ই নয়, সারাদেশের মানুষের জন্য অনুকরণীয় হতে পারে। ভাসমান বীজতলা সম্প্রসারণের মাধ্যমে কৃষকের বার বার বীজ ক্রয়ে আর্থিক ক্ষতি লাঘব হবে। পাশাপাশি মৌসুমের শুরুতে দুযোর্গ মোকাবেলা করে ধান চাষ করতে পারবেন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর খুলনার উপ-পরিচালক নজরুল ইসলাম বলেন, এটি ভালো উদ্যোগ। কৃষকের ঝুঁকি কমাতে উঁচুস্থানে বা ভেলা বা বিকল্পভাবে বীজতলার ব্যবস্থা করতে হবে। যা তাদের ক্ষতি কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।