ডেক্স রিপোর্ট
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৪ বছর বয়সী ছাত্রলীগ নেতা ফাহমি (ছদ্মনাম) এখন এক ভয়াবহ বিপর্যয়ের সম্মুখীন। কয়েক সপ্তাহ আগেও তিনি ছিলেন একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য; কিন্তু আজ তিনি আত্মগোপনে। গত আগস্টে ছাত্রদের নেতৃত্বাধীন আন্দোলনের ফলে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয় এবং শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যান। পরে নতুন অন্তর্র্বতী সরকার ছাত্রলীগকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ঘোষণা করার পর ফাহমি ও তার মতো হাজারো ছাত্র এখন সহিংসতা, গ্রেফতার ও প্রতিশোধের ভয়ে জীবন যাপন করছেন। গত বুধবার ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্র্বতী সরকার ছাত্রলীগকে একটি ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ ঘোষণা করে। সরকার বলেছে, ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে সহিংসতা, হয়রানি ও গুরুতর অসদাচরণের অভিযোগ রয়েছে।
ফলিত রসায়নের স্নাতকের শিক্ষার্থী ফাহমি বলেন, কিছুদিন আগে আমি এখানে কর্তৃত্বের কণ্ঠস্বর ছিলাম। এখন আমি ফেরারির মতো ছুটছি, যার সামনে কোনো ভবিষ্যৎ নেই। তিনি বলেন, হাসিনা বিরোধী বিক্ষোভের সময় জনগণের বিরুদ্ধে সরকারের প্রাণঘাতী দমন–পীড়নে তিনি সরাসরি অংশগ্রহণ করেননি। আমার বোনেরা বিক্ষোভে অংশ নিয়েছিলেন। আমিও মনে করতাম, দাবি সঠিক। কিন্তু আমি দলীয় বাধ্যবাধকতায় আটকা পড়েছিলাম। সরকারি চাকরিতে বিতর্কিত কোটাব্যবস্থা বাতিলের দাবিতে গত জুলাইয়ে বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল, যা পরে হাসিনার ‘স্বৈরাচারী’ শাসনের বিরুদ্ধে গণবিদ্রোহে রূপ নেয়। সরকারের প্রতিক্রিয়া ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে রক্তাক্ত অধ্যায়গুলোর মধ্যে একটি। কারণ, নিরাপত্তা বাহিনী বিক্ষোভকারীদের মারধর করে। তারা শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের ওপর কাঁদানে গ্যাসের শেল ও গুলি ছোড়ে। তিন সপ্তাহে এক হাজারের বেশি মানুষ নিহত হন। হাজারো মানুষকে গ্রেফতার করা হয়। গত ৫ আগস্ট প্রতিবাদী ছাত্র-জনতা শেখ হাসিনার বাসভবন, সংসদ ভবনসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সরকারি ভবনগুলোয় হামলা চালান। ৭৭ বছর বয়সী প্রধানমন্ত্রী একটি সামরিক হেলিকপ্টারে করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। হাসিনার পতনের পর ছাত্রলীগসহ আওয়ামী লীগের শত শত সদস্য ও রাজনীতিবিদরা হামলার শিকার হন। অনেকে আত্মগোপনে চলে যান। কিংবা পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে আটক হন। ফাহমি বলেন, ‘হাসিনা বিরোধী বিক্ষোভকারীরা ঢাকা থেকে ১৭৩ কিলোমিটার দূরে নোয়াখালী জেলায় তার পরিবারের বাড়ি ও কোল্ডস্টোরেজ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে আগুন দিয়েছেন। আমি কোথায় আছি, তা না জানালে তারা আমার ছোট ভাইকে হাওয়া করে দেবে বলে হুমকি দিয়েছেন।’ তিনি বলেন, ‘এখন পর্যন্ত তারা তেমন কিছু করেননি। যদিও তার ছোট ভাই যে মাদরাসায় পড়ে, সেখানে সে পীড়নের শিকার হয়েছে।’ ফাহমি ছাত্রলীগের সঙ্গে যুক্ত থাকার কথা স্বীকার করে বলেন, ‘আমি ভালো ছাত্র ছিলাম। রাজনীতি নিয়ে আমি খুব কমই চিন্তা করতাম। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হল রাজনীতি এড়ানো যায় না।’ দুই বছর আগে তার বাবা মারা যান এবং বাবার মৃত্যুর পর পরিবারের দায়িত্ব তার ওপর এসে পড়ে। তিনি মনে করেন, ছাত্রলীগের একজন নেতা হওয়ার ফলে সরকারি চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা বেড়েছিল। অথচ, এই আনুগত্যের কারণে তিনি পরিবারের জন্য সবসময় পাশে থাকতে পারেননি। ২০২২ সালে বাবার মৃত্যুর একদিন পর তিনি ১৫ আগস্টের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ঢাকায় আসেন, যখন তার পরিবার শোকাহত ছিল। ফাহমি বলেন, পেছনে ফিরে তাকালে দেখি, আমি আমার পরিবারকে সমর্থন করার চেয়ে দলকে অগ্রাধিকার দিয়েছি। এখন যখন নেত্রী হাসিনা ভারতে নিরাপদে আছেন, তিনি ক্রমাগত সহিংসতা এবং গ্রেফতারের হুমকির সম্মুখীন হচ্ছেন। এই পরিস্থিতি তাকে বুঝিয়ে দিয়েছে যে একসময় তিনি যে দলের প্রতিনিধিত্ব করেছেন এবং যে বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনি ছাত্র, তারা তাকে পরিত্যাগ করেছে। তিনি বলেন, আমি যে সালাম দিতাম এবং ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিনিয়োগ করেছিলাম আমাদের নেতাদের জন্য এবং দলীয় সমাবেশের আয়োজনে, এখন তা অর্থহীন মনে হচ্ছে। ফাহমির শেষ বর্ষের পরীক্ষা চলছে, কিন্তু তিনি ক্লাসে যোগ দিতে পারছেন না। তিনি বলেন, আমি সরকারি চাকরিতে যোগ দিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু ক্যাম্পাসে পা রাখলে নানা অভিযোগে আমাকে গ্রেফতার করা হতে পারে, অথবা আমাকে মারধর করা হতে পারে।
ফাহমি একাই এই পরিস্থিতিতে পড়েননি। আওয়ামী লীগের আনুমানিক ৫০ হাজার ছাত্র এখন অচলাবস্থায় ভুগছেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেত্রী শাহরিন আরিয়ানা। পরিবার বলেছে, ১৮ অক্টোবর তাঁকে ‘ভুয়া’ অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে। টার্ম ফাইনাল পরীক্ষা দিতে গিয়ে শাহরিন আটক হন। একই দিন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক ছাত্রলীগ নেতা সৈকত রায়হানকে গ্রেফতার করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর মাহবুবর রহমান জানান, ছাত্রলীগের কোনো নেতার সঙ্গে পরীক্ষায় বসতে রাজি হননি অন্য শিক্ষার্থীরা। এজন্য তাদের পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। ২৫ অক্টোবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিতে এসে আরো দুই ছাত্রলীগ নেতা গ্রেফতার হন—ফিন্যান্সের ছাত্র আবুল হাসান সাইদী এবং নৃবিজ্ঞানের ছাত্র কাজী শিহাব উদ্দিন তৈমুর। প্রক্টর সাইফুদ্দিন আহমেদ বলেন, দুই শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে। সে অনুযায়ী তাঁদের গ্রেফতার করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ-সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে সহিংসতার ঢেউ ক্যাম্পাসে ছড়িয়ে পড়েছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রলীগ নেতা শামীম আহমেদকে ১৮ সেপ্টেম্বর পিটিয়ে হত্যা করা হয় এবং ৭ সেপ্টেম্বর রাজশাহীতে মাসুদ নামে এক ছাত্রলীগ নেতা নিহত হন। হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্র্বতী সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে এবং ২৩ অক্টোবর এক গেজেটে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে (২০০৯) ছাত্রলীগকে আনুষ্ঠানিকভাবে নিষিদ্ধ করে। ২০০৯ সালে হাসিনার সরকার ক্ষমতায় আসার পরপরই এই আইন পাস করা হয়েছিল। ছাত্রলীগ নিষিদ্ধের দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনসহ অন্যান্য সংগঠনের নেতৃত্বে দেশব্যাপী বিক্ষোভের পর এই সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। — সূত্র - আল জাজিরা