প্রতিনিধি 13 July 2025 , 5:23:37 প্রিন্ট সংস্করণ
খুলনা, ১৩ জুলাই ২০২৫:
শিল্প ও বাণিজ্যিক নগরী খুলনা এখন পরিণত হয়েছে আতঙ্কের জনপদে। গত ১০ মাসে মহানগরীতে সংঘটিত হয়েছে ২৭টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা, অর্থাৎ প্রতি মাসে গড়ে প্রায় তিনটি প্রাণহানি। খুন ছাড়াও গুলি, চুরি, ছিনতাই, ও কোপাকুপির মতো সহিংস অপরাধ এখন খুলনার নিত্যদিনের ঘটনা। এমন পরিস্থিতিতে খুলনার রাজনৈতিক ও নাগরিক সমাজের নেতারা আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে গভীর উদ্বেগ ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। সর্বশেষ গত শুক্রবার দিনে-দুপুরে সন্ত্রাসীরা গুলি করে ও রগ কেটে হত্যা করেছে যুবদলের বহিষ্কৃত নেতা মাহবুবুর রহমান মোল্লা (৪০)-কে, যা নগরবাসীর মধ্যে নতুন করে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে।
অপরাধের পরিসংখ্যান ও পুলিশের বক্তব্য
খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের (কেএমপি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট থেকে চলতি বছরের ১১ জুলাই পর্যন্ত খুলনা মহানগরীতে মোট ২৭টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। এই সময়ে ২০টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। মাসভিত্তিক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০২৪ সালের আগস্টে ২টি, সেপ্টেম্বরে ১টি, অক্টোবরে ২টি, নভেম্বরে ৪টি এবং ডিসেম্বরে সর্বোচ্চ ৬টি হত্যাকাণ্ড ঘটে। চলতি বছরের শুরুতে জানুয়ারি মাসে ২ জন, ফেব্রুয়ারিতে ১টি, মার্চে ১টি এবং এপ্রিল, মে, জুন ও জুলাই (এ পর্যন্ত) মাসে ৭ জন হত্যার শিকার হয়েছেন।
নগরীর আটটি থানার মধ্যে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা প্রায় সব থানা এলাকাতেই ছড়িয়ে পড়েছে। খানজাহান আলী থানা থেকে শুরু করে হরিণটানা, সোনাডাঙ্গা, লবণচরা, সদর, খালিশপুর, দৌলতপুর, এবং আড়ংঘাটা থানাতেও হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে।
কেএমপি’র দাবি, ২৭টি হত্যাকাণ্ডের মধ্যে দুটি মরদেহ নদীতে ভেসে আসায় সেগুলোর তদন্ত নৌপুলিশের অধীনে। বাকি ২৫টি হত্যাকাণ্ডের মধ্যে ২২টির পেছনের ঘটনা উদ্ঘাটন করতে সক্ষম হয়েছে কেএমপি। শুক্রবারের হত্যাকাণ্ডসহ মোট তিনটি মামলা বর্তমানে পুলিশের তদন্তাধীন রয়েছে।
খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) মোহাম্মদ রাশিদুল ইসলাম খান গণমাধ্যমকে জানান, “আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। তবে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো বিভিন্নভাবে বিভক্ত হয়ে তাদের আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করছে, যার ফলে অপরাধ কর্মকাণ্ডগুলো ঘটছে। আমরা ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই মাহবুবুর হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের শনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছি। আশা করি দ্রুত অবস্থার পরিবর্তন হবে।” তিনি আরও বলেন, মাদকের কারণে তরুণ প্রজন্মের ভবিষ্যৎ নষ্ট হচ্ছে এবং মাদক বিক্রেতা, বাহক ও যারা খুলনার বাইরে থেকে মাদক নিয়ে আসে, তাদের ওপর পুলিশের নজরদারি অব্যাহত আছে।
নেতা ও সুশীল সমাজের উদ্বেগ
খুলনা মহানগরীর আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতিতে গভীর উদ্বেগ ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছে খুলনা বিএনপি। দলটির নেতারা এক যুক্ত বিবৃতিতে বলেন, খুন, অস্ত্রের মহড়া, চুরি, ডাকাতি ও লুটপাটের মতো ঘটনা খুলনায় এখন নিত্যদিনের বিষয়। প্রায় প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, গোলাগুলি ও খুনসহ সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটছে। সর্বশেষ যুবদল নেতা মাহবুবুর রহমান মোল্লার হত্যাকাণ্ডসহ গত ১০ মাসে মহানগরীতে ২৭টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, যা নগরবাসীকে শঙ্কিত করে তুলেছে। বিএনপি নেতারা আরও বলেন, মহানগরীর আইন-শৃঙ্খলা অবনতির দায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কোনোভাবেই এড়াতে পারে না। তাই দ্রুত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন মহানগর বিএনপি সভাপতি অ্যাডভোকেট শফিকুল আলম মনা, জেলা আহ্বায়ক মনিরুজ্জামান মন্টু, মহানগর সাধারণ সম্পাদক শফিকুল আলম তুহিনসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ।
খুলনার নাগরিক সমাজের সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট বাবুল হাওলাদারও উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, “খুলনার মানুষ সব সময়ই শান্তি প্রিয়। তারা শান্তিতে জীবনযাপন করতে চান। কিন্তু এখন আর সেই পরিস্থিতি নেই। সন্ধ্যা নামলেই খুলনাবাসীর মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করে। এখন আবার শুরু হলো প্রকাশ্য দিবালোকে খুন। খুলনার পুলিশ প্রশাসন আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে আনতে চরমভাবে ব্যর্থ হচ্ছে। সাধারণ মানুষ হিসেবে এমন অবস্থা কাম্য নয়।”