নিজস্ব প্রতিবেদকঃ
বান্দরবানের লামা উপজেলার সরই ইউনিয়নে জালিয়াতি করে ১৫ বছরে প্রায় ১৫শ একর জমির মালিক হয়েছেন মোহাম্মদ আলী সিকদার নামের আওয়ামী লীগের নেতা ও তার ছেলে। আলী লামা উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও তার ছেলে দস্তগীর সিকদার মানিক সরই ইউনিয়ন যুবলীগের ধর্মবিষয়ক সম্পাদক।
বাবা-ছেলে মিলে জালিয়াতি করে ও ভয়ভীতি দেখিয়ে সরই ও ডলুছড়ি মৌজায় মোহাম্মদ আলীর নামে ৬শ একর, তার স্ত্রী শামসুন্নাহার বেগমের নামে ২শ একর, বড় ছেলে আলমগীর সিকদারের নামে সাড়ে ৬শ একর, ছোট ছেলে দস্তগীর সিকদার মানিকের নামে ৫০ একর জমি রেজিস্ট্রি করে নিয়েছে। এখন এসব ভিটেমাটি ফেরত চান অসহায় ভুক্তভোগীরা।
সর্বশেষ বিগত জুলাই আগস্টের দলীয় দাপট খাটিয়ে লামা সুয়ালক সড়ক দখল করে সরই বাজারে মার্কেট নির্মাণ করেন মোহাম্মদ আলী সিকদার। মোহাম্মদ আলীর জালিয়াতির শিকার শত বছরের বৃদ্ধ সাহেব আলী তালুকদার বলেন, লামা সরই ইউনিয়নে যে জায়গাটির ওপর মোহাম্মদ আলীর নজর পড়েছে সেটি সে যেকোনো কৌশলে জালিয়াতি ও জবরদখল করে নিয়ে ছাড়ছেন। তালুকদারের প্রায় ৩০ একর জমি প্রথমে জালিয়াতি করে মোহাম্মদ আলী ও তার পরিবারের লোকদের নামে রেজিস্ট্রি করে নেয়। পরে একদিন পাহাড়ি হাতি এসে তালুকদারের ঘরবাড়ি ভেঙে দেয় ও তার স্ত্রী হাতির আক্রমণে মারা যান। পরে তিনি তার বাড়ি মেরামত করতে গেলে মোহাম্মদ আলী গিয়ে জমিগুলো তার বলে দাবি করেন এবং ঘর মেরামতে বাধা দেন। পরে তালুকদারকে হত্যার হুমকি দিলে তিনি বাড়ি ছেড়ে খাগড়াছড়িতে তার মেয়ের কাছে আশ্রয় নেন।
বিধবা ছালেহা বেগম বলেন, মোহাম্মদ আলী ইউপি চেয়ারম্যান থাকাকালীন সরকারি টাকায় তার জমিতে বাঁধ দিয়ে পানি জমিয়ে মাছ চাষ করার প্রস্তাব দেন। ছালেহা বেগম রাজি হন। কারণ তাকে জানানো হয় মাছ বা পানি সবটাই ছালেহা বেগমের মালিকানায় থাকবে। সরকার গরিব কৃষকদের জন্য এটা ব্যবস্থা করেছে। জমিতে বাঁধ দিয়ে মাছ চাষের ৬ মাস পর কে বা কারা ছালেহা বেগমের স্বামীকে মেরে রাস্তায় ফেলে রাখে। এর কিছুদিন পর ছালেহা বেগমের ঘরে কে বা কারা আগুন দেয়। এতে ঘরের সঙ্গে তাদের সব কাগজ ও দলিলাদি পুড়ে যায়। পরে আরও দুবার একই কায়দায় ঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়।
বাড়ি হারানো ছালেহা বেগম কেঁদে বলেন, গত ২ বছর আগে মোহাম্মদ আলীর ছেলে দস্তগীর সিকদার মানিক ১২-১৩ জন সন্ত্রাসী নিয়ে এসে বলে এসব জমি তাদের। পরে আরও কয়েকবার হুমকি দেয়। আমরা বাড়ি ছাড়তে না চাইলে রাতের আঁধারে সন্ত্রাসী নিয়ে এসে আমার মেয়ে ময়নাকে নির্যাতনের চেষ্টা চালায়। পরদিন আমরা অন্যত্র চলে যাই। পরে জানতে পারি আমাদের জমিগুলো মোহাম্মদ আলী তার ছেলে অনেক আগে জালিয়াতি করে তাদের নামে রেজিস্ট্রি করে নামজারি করেছে। আমরা চলে আসার পর আমাদের জমিগুলো সাবেক মন্ত্রী তাজুল ইসলামের কাছে ৭০ লাখ টাকায় বিক্রি করে দিয়েছে। ছালেহা বেগমের আশপাশে আরও শতাধিক কৃষক মোহাম্মদ আলীর হামলার ভয়ে দিন কাটাচ্ছেন। কারণ তাদের জমিগুলোও মোহাম্মদ আলী নিজ ও পরিবারের লোকদের নামে জালিয়াতি করে নিয়ে নেন।
সরই বাজার এলাকায় আছমা বেগম বলেন, ২০১৯ সালে তার জমিতে তার ছেলেরা তিনটি পাকা দোকান নির্মাণ করে। দোকানে টিন দেওয়ার সময় হঠাৎ মোহাম্মদ আলীর ছেলে দস্তগীর মানিক সিকদার একদল সন্ত্রাসী নিয়ে এসে দোকানে টিন লাগাতে বাধা দেয়। সে বলে জায়গাটি নাকি তার পরিবারের। মানিকের ভয়ে আছমা বেগম এখনো দোকানে টিন লাগাতে পারনি। একই এলাকায় মোহাম্মদ হানিফ নামের আরেক কৃষকদের ধানি জমি মানিক সিকদারে দাবি করে কয়েকবার জবরদখল করতে যায়।
মোহাম্মদ আলী সিকদার ১৯ বছর লামা সরই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। সেই সুবাদে এলাকার প্রায় প্রতিটি কৃষকের জায়গাজমি থেকে শুরু করে সবকিছু তার নখদর্পণে। প্রায় সবার ছবি তার কাছে ছিল। সেই ছবি ও আগেকার তার স্বাক্ষরিত চেয়ারম্যান সনদ ব্যবহার করে ভুয়া আইডি কার্ড বানিয়ে ভূমি কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে মূলত তিনি জালিয়াতি করে অন্যের জমি নিজ নামে করে নেন।
মোহাম্মদ আলী শুধু নিজের জন্য নয়, আওয়ামী লীগের বিভিন্ন নেতাকে জমি দখল করে দিয়েছেন। বিশেষ করে সাবেক স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় (এলজিআরডি) মন্ত্রী তাজুল ইসলামের স্ত্রীকে প্রায় ৫শ’ একর জমি চুক্তিভিত্তিক জবরদখল করে দেন।
মোহাম্মদ আলী বলেন, তার বিরুদ্ধে আসা অভিযোগগুলো সঠিক নয়। জমি দখল ও দলিল জালিয়াতি করে সন্ত্রাসী দিয়ে ঘরবাড়ি থেকে উচ্ছেদ করার বিষয় তিনি বলেন, এসব আমি করিনি।
লামা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রূপায়ণ দেব বলেন, এ বিষয়ে কোনো অভিযোগ পেলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।