প্রতিনিধি 4 September 2025 , 2:43:26 প্রিন্ট সংস্করণ
খবরটি প্রথমে বার্তার মাধ্যমে পেয়েছিলাম। আমাকে বলা হয়েছিল, কাউকে যেন কিছু না জানাই। তখন আমার মুখে আনন্দের এক অগাধ হাসি ফুটে উঠেছিল। আমি পরিবারকে বলেছিলাম, দল ঘোষণার দিকে চোখ রাখতে। সত্যিই সেটা ছিল আমার জীবনের এক অনন্য, স্মরণীয় মুহূর্ত’—ইংল্যান্ড জাতীয় ফুটবল দলে প্রথমবারের মতো ডাক পাওয়ার অভিজ্ঞতা এভাবেই জানিয়েছেন দিয়েদ স্পেন্স।
আগামী শনিবার অ্যান্ডোরা এবং বুধবার সার্বিয়ার বিপক্ষে খেলবে ইংল্যান্ড। ফিফা বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের ম্যাচ দুটির জন্য স্পেন্সকে ডেকেছেন কোচ টমাস টুখেল। ম্যাচ দুটির একটিতে মাঠে নামলেই স্পেন্স হবেন ইংল্যান্ড জাতীয় ফুটবল দলের প্রথম মুসলিম খেলোয়াড়। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের ক্লাব টটেনহামের এই ফুলব্যাকের সঙ্গে টুখেলের আগে কখনো কথা হয়নি। তাই আচমকা জাতীয় দলে ডাক পাওয়ায় যেমন বিস্মিত হয়েছেন, তেমনি সম্মানিত বোধও করছেন।
তিনিই যে ইংল্যান্ড জাতীয় দলে ডাক পাওয়া প্রথম মুসলিম ফুটবলার, তা ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম থেকেই জেনেছেন স্পেন্স। এ বিষয়ে এফএ (ইংলিশ ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন) ওয়েবসাইটকে তিনি বলেছেন, ‘আমি খবরটা দেখেছি। এটা আমার কাছে আশীর্বাদ, অসাধারণ ব্যাপার। প্রথমে শুনে অবাক হয়েছিলাম। কী বলব বুঝতে পারছিলাম না।’
প্রথম মুসলিম ফুটবলার হিসেবে চাপ অনুভব করছেন কি না—এমন প্রশ্নে তিনি বলেছেন, ‘হতে পারে, আবার নাও পারে। আসলে আমি তেমন চাপ নিই না। শুধু হাসিমুখে ফুটবল খেলি, খুশি থাকার চেষ্টা করি, বাকি আপনাআপনি হয়ে যায়।’
স্পেন্সের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ধর্মীয় বিশ্বাস, যা তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রায়ই তুলে ধরেন। ধর্ম নিয়ে আবারও বললেন, ‘প্রথম কথা হলো সৃষ্টিকর্তাই সর্বশ্রেষ্ঠ। আমি অনেক প্রার্থনা করি, সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি। জীবনের সবচেয়ে কঠিন আর অন্ধকার সময়গুলোতেও আমি বিশ্বাস করেছি, সৃষ্টিকর্তা আমার পাশে আছেন। আর যখন আমি সফল হই, খুশির মুহূর্ত আসে, তখনো তাঁকে স্মরণ করি। তাঁর প্রতি বিশ্বাসই আমার সবচেয়ে বড় শক্তি।’
দিয়েদ স্পেন্সের জন্ম ২০০০ সালের ৯ আগস্ট লন্ডনে। তাঁর বাবা জ্যামাইকান, মা কেনিয়ান। বাবার নাম সিমোন স্পেন্স, মায়ের নাম আয়শা। মায়ের ধর্মই তিনি গ্রহণ করেছেন। তাঁর বড় বোন কার্লা-সিমোন স্পেন্স ব্রিটেনের বেশ পরিচিত অভিনয়শিল্পী। কার্লা-সিমোন অবশ্য নিজের মাকে কখনো কেনিয়ান হিসেবে পরিচয় দেননি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁর বাবা-মাকে ব্রিটিশ-জ্যামাইকান হিসেবে তুলে ধরেছেন।
যুব ফুটবলে দিয়েদ স্পেন্সের শুরুটা হয় ২০১৬ সালে, লন্ডনেরই ক্লাব ফুটবলকে দিয়ে। পেশাদার ফুটবলে তাঁর অভিষেক ২০১৮ সালে, মিডলসবরোর হয়ে। ক্লাবটিতে চার বছর থাকলেও ২০২১-২২ মৌসুম ধারে খেলেছেন নটিংহাম ফরেস্টে। সেবারই নটিংহাম ২৩ বছর পর প্রিমিয়ার লিগে উঠে আসে। স্পেন্সের পারফরম্যান্সও অনেকের নজরে আসে।
২০২২ সালে গ্রীষ্মকালীন দলবদলে স্পেন্সকে দলে ভেড়ায় টটেনহাম। কিন্তু ক্লাবটির তৎকালীন কোচ আন্তোনিও কন্তে প্রকাশ্যেই জানিয়ে দেন, স্পেন্স তাঁর পরিকল্পনায় নেই। কন্তের কথাটি স্পেন্সের জন্য বড় ধাক্কা হয়ে আসে। তাঁর সময়ে টটেনহামের হয়ে খেলার সুযোগ পেয়েছেন কমই। উল্টো ধারে পাঠানো হয়েছে ফরাসি ক্লাব রেনে, ইংলিশ ক্লাব লিডস ইউনাইটেড ও ইতালিয়ান ক্লাব জেনোয়ায়।
অ্যাঞ্জ পোস্তেকোগলু কোচ হওয়ার পর অবশেষে গত মৌসুমে টটেনহামে ফিরে আসেন স্পেন্স। পোস্তেকোগলুর দলে তিনি নিয়মিতই খেলেছেন। ১৭ বছর পর টটেনহামকে প্রথম ট্রফি (উয়েফা ইউরোপা লিগ) জেতাতেও অবদান রেখেছেন। ক্লাবটির বর্তমান কোচ টমাস ফ্রাঙ্কও স্পেন্সের ওপর আস্থা রেখেছেন। সম্প্রতি তাঁর সঙ্গে ২০২৯ সালের জুন পর্যন্ত চুক্তির মেয়াদ বাড়িয়েছে উত্তর লন্ডনের ক্লাবটি।
কন্তের সময়ে উপেক্ষিত থাকার দুঃস্মৃতি নিয়ে স্পেন্স বলেন, ‘ফরেস্টের হয়ে দুর্দান্ত খেলেছিলাম, দলকে প্রিমিয়ার লিগে তুললাম। টটেনহামে যোগ দিতে যাচ্ছি ভেবে খুব রোমাঞ্চিত ছিলাম। কিন্তু সেসময় এমন মন্তব্য (কন্তের কথা) শোনা মোটেও ভালো ব্যাপার ছিল না।। আত্মবিশ্বাস ভেঙে গিয়েছিল কিছুটা। তবে আমি লড়াকু মানুষ। যা-ই করি, সর্বোচ্চটা দেওয়ার চেষ্টা করি। নিজের ওপর বিশ্বাস আর সৃষ্টিকর্তার ওপর ভরসা রাখলে সব ঠিক হয়ে যায়।’
নিজের দুঃসময়ে সমালোচনাকে অনুপ্রেরণায় পরিণত করাও শিখেছেন স্পেন্স, ‘আমি মনে করি, আমার শক্ত মানসিকতা চ্যালেঞ্জ পার হতে সহায়তা করেছে। যারা আমাকে নিয়ে সন্দেহ করেছে, তাদের আমি মনে রাখি। তাদের ভুল প্রমাণ করতে সত্যিই ভালো লাগে।’
২৫ বছর বয়সী এই ডিফেন্ডারের চাওয়া, তাঁর এই যাত্রা অন্যদের অনুপ্রাণিত করুক, ‘আমি পারলে আপনিও পারবেন। শুধু মুসলিম শিশুরা নয়, যেকোনো ধর্মের যেকোনো শিশুই পারবে। মনোযোগী হলে, পরিশ্রম করলে সবই সম্ভব।’
স্পেন্সকে ইংল্যান্ড দলে ডাকার একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন কোচ টুখেল। তিনি বলেছেন, ‘গত মৌসুমের শেষ দিকে এবং এই মৌসুমের শুরুতে ওর পারফরম্যান্স চমৎকার ছিল। প্যারিসের (পিএসজি) মতো মানসম্পন্ন ও গতিময় দলের বিপক্ষে উয়েফা সুপার কাপ ফাইনালে সে দুর্দান্ত খেলেছে। প্রিমিয়ার লিগেও ভালো করছে। সে দুই পাশেই খেলতে পারে। শারীরিক দিক থেকেও ভালো অবস্থায় আছে। আমার মনে হয়েছে, এটা ওর প্রাপ্য ছিল।’
এখন টুখেলকে সঠিক প্রমাণ করার পালা স্পেন্সের।