প্রতিনিধি 5 September 2025 , 6:03:37 প্রিন্ট সংস্করণ
জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি হিসেবে কিছু ক্ষেত্রে গণভোট, কিছু ক্ষেত্রে বিশেষ সাংবিধানিক আদেশসহ একাধিক বিকল্প চিন্তা করছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। বিশেষ করে সংসদের উচ্চকক্ষের সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে (পিআর) নির্বাচন প্রশ্নে গণভোটের সুপারিশ করার বিষয়টি ভাবা হচ্ছে। আর সংবিধান-সংশ্লিষ্ট নয়, এমন প্রস্তাবগুলো অধ্যাদেশ ও নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে বাস্তবায়নের পরামর্শ দেওয়া হবে। ঐকমত্য কমিশনের একাধিক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
বাস্তবায়নের উপায় বা পদ্ধতি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত ও বিশেষজ্ঞদের মতামত সমন্বয় করে এটি চূড়ান্ত করা হবে। এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আবার বৈঠক করবে ঐকমত্য কমিশন। এরপর জুলাই জাতীয় সনদ এবং সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে সুপারিশ একসঙ্গে আগামী সপ্তাহে রাজনৈতিক দল ও সরকারের কাছে পাঠানো হবে। বাস্তবায়নের পদ্ধতি জুলাই সনদের অংশ হবে না।
সনদ চূড়ান্ত করা ও বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার ও আগের দিন কমিশন নিজেদের মধ্যে বৈঠক করে। গতকালই জুলাই সনদের চূড়ান্ত খসড়া দলগুলোর কাছে পাঠানোর আশা ছিল কমিশনের। তবে শেষ পর্যন্ত হয়নি। সনদ অনেকটা চূড়ান্ত হলেও কমিশন চাইছে বাস্তবায়নের উপায় এবং সনদ দুটো একসঙ্গে পাঠাতে। এ জন্য আরও সময় নেওয়া হচ্ছে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ প্রথম আলোকে বলেন, কমিশন জুলাই সনদের চূড়ান্ত রূপ দাঁড় করিয়েছে। সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি কী হতে পারে, তা নিয়ে কমিশন পরামর্শ দেবে। বাস্তবায়নের পদ্ধতিটি নিশ্চিত করার পর সনদ ও বাস্তবায়নের উপায়—এ দুটি দলিল একসঙ্গে দলগুলোর কাছে পাঠানো হবে।
ছয়টি সংস্কার কমিশনের সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দুই পর্বের আলোচনায় ৮৪টি বিষয়ে ঐকমত্য ও সিদ্ধান্ত হয়। এগুলো নিয়ে তৈরি করা হচ্ছে জুলাই জাতীয় সনদ। সনদের তিনটি ভাগ থাকবে। প্রথম ভাগে সনদের পটভূমি, দ্বিতীয় ভাগে ঐকমত্য ও সিদ্ধান্ত হওয়া প্রস্তাব এবং তৃতীয় ভাগে থাকছে সনদ বাস্তবায়নের অঙ্গীকারনামা।
যে ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাবের বিষয়ে ঐকমত্য ও সিদ্ধান্ত হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে কিছু বিষয় আছে যেগুলো পরিবর্তনে আইন-বিধি পরিবর্তন করতে হবে। কিছু বিষয়ে সরকারি আদেশ প্রয়োজন হবে। এগুলো রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ, বিধি প্রণয়ন এবং সরকারের নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা সম্ভব। আর বেশ কিছু বিষয় আছে সংবিধান-সংক্রান্ত। মূল জটিলতা সংবিধান সংস্কার সম্পর্কিত প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়ন প্রশ্নে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ঐকমত্য কমিশন অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনেই সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নের পদ্ধতিকে প্রাধান্য দিচ্ছে। তবে এ ক্ষেত্রে বিএনপির অবস্থান ভিন্ন। তারা তিন ধাপে সনদ বাস্তবায়নের কথা বলেছে। দলটি সংবিধান-সংক্রান্ত সংস্কারগুলো আগামী সংসদ গঠনের পরবর্তী দুই বছরের মধ্যে সম্পন্ন করার পক্ষে। তারা ইতিমধ্যে এ মতামত লিখিতভাবে কমিশনকে দিয়েছে।
অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী চায় গণভোট বা রাষ্ট্রপতির প্রোক্লেমেশনের মাধ্যমে সনদের বাস্তবায়ন। আর জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) গণপরিষদ গঠনের মাধ্যমে সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নের পক্ষে। জামায়াত ও এনসিপি আজ বা আগামীকাল লিখিতভাবে তাদের প্রস্তাব দেবে বলে জানা গেছে। এর আগে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনায় সংবিধান সংস্কারের প্রস্তাবগুলো গণভোট, রাষ্ট্রপতির প্রোক্লেমেশন, বিশেষ সাংবিধানিক আদেশ, উচ্চ আদালতের রেফারেন্স নেওয়াসহ বিভিন্ন মত আসে।
ঐকমত্য কমিশন সূত্র জানায়, সব প্রস্তাব নিয়ে গণভোট দেওয়া সম্ভব হবে না। এখন পর্যন্ত উচ্চকক্ষে পিআর পদ্ধতি নিয়ে গণভোটের সুপারিশ করার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে ভাবা হচ্ছে। কারণ, উচ্চকক্ষ গঠনে সবাই একমত হলেও নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে মতভিন্নতা প্রকট। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে গণভোটে যাওয়া প্রয়োজন। এর সঙ্গে আরও কিছু বিষয়েও (যেগুলোতে নোট অব ডিসেন্ট আছে) গণভোট করার পরামর্শ দেওয়া হতে পারে। সংবিধান সংস্কার-সংক্রান্ত অন্য যেসব প্রস্তাবে ঐকমত্য আছে, সেগুলোর বাস্তবায়নপ্রক্রিয়া হিসেবে বিশেষ সাংবিধানিক আদেশ জারির সুপারিশ করার কথা বিবেচনা করা হচ্ছে। তবে এটি কি রাষ্ট্রপতির প্রোক্লেমেশন হবে, নাকি বিশেষ সাংবিধানিক আদেশ হবে, তা এখনো ঠিক করা যায়নি।
সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব ছিল, পিআর পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ গঠন করা হবে। অর্থাৎ নিম্নকক্ষের নির্বাচনে একটি দল সারা দেশে যত ভোট পাবে, তার অনুপাতে উচ্চকক্ষে আসন পাবে। জামায়াতে ইসলামী, এনসিপিসহ বেশির ভাগ দল এ প্রস্তাবে একমত। তবে বিএনপিসহ কয়েকটি দলের এখানে ভিন্নমত আছে। তারা চায় একটি দল নিম্নকক্ষে যত আসন পাবে, তার ভিত্তিতে উচ্চকক্ষে আসন পাবে।
তিন ধাপে বাস্তবায়ন চায় বিএনপি
জুলাই সনদের প্রস্তাবগুলো তিন ধাপে বাস্তবায়নের পক্ষে বিএনপি। দলটি কমিশনকে লিখিতভাবে তাদের এই মত জানিয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, সংবিধান-সংক্রান্ত সংস্কার প্রস্তাবগুলো বাদে অন্য যেসব আশু করণীয় সুপারিশ আছে, সেগুলো অন্তর্বর্তী সরকার দ্রুত বাস্তবায়ন করবে। এ ক্ষেত্রে সরকার প্রয়োজনীয় অধ্যাদেশ, বিধি প্রণয়নে প্রশাসনিক আদেশ জারি করতে পারে।
সংবিধান-সম্পর্কিত নয় এবং আশু করণীয় নয় এমন প্রস্তাবগুলো যথাসম্ভব বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া শুরু করবে অন্তর্বর্তী সরকার। আর সংবিধান সংস্কার-সংক্রান্ত প্রস্তাবগুলো আগামী সংসদ গঠনের দুই বছরের মধ্যে বাস্তবায়ন করা হবে।
বিএনপি বলেছে, নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরবর্তী দুই বছরের মধ্যে জুলাই সনদের বাস্তবায়ন নিশ্চিত করবে। সব দল জুলাই সনদে সই করা এবং নির্বাচনী ইশতেহারে বিষয়টি উল্লেখ করে জাতির কাছে অঙ্গীকারবদ্ধ থাকবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বিএনপি বলেছে, অন্তর্বর্তী সরকার বিদ্যমান সংবিধানের অধীনে গঠিত হয়েছে। গণ-অভ্যুত্থানে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা ক্ষুণ্ন হয়নি। সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা চলমান থাকা অবস্থায় প্রস্তাবিত জুলাই জাতীয় সনদকে সংবিধানের ওপর মর্যাদা দেওয়ার চেষ্টা অসংগত। সংবিধানের অধীনে গঠিত কোনো সরকার রাষ্ট্রীয় শক্তি ব্যবহার করে বিদ্যমান সংবিধানের জায়গায় নতুন কোনো সাংবিধানিক ব্যবস্থা প্রবর্তন করলে সেটি ‘ক্যু’ হিসেবে গণ্য হয়। সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা ক্ষুণ্ন করার কোনো ধরনের চেষ্টা বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বাস্তবসম্মত নয়।
অঙ্গীকার অংশে যে পরিবর্তন আসছে
ঐকমত্য কমিশন সনদের একটি সমন্বিত খসড়া দলগুলোকে দিয়েছিল। সেখানে অঙ্গীকারনামায় আটটি দফা ছিল। এর মধ্যে জুলাই সনদকে সংবিধানের ওপরে প্রাধান্য দেওয়া, সনদের বৈধতা নিয়ে আদালতে প্রশ্ন করা যাবে না, সনদের ব্যাখ্যার ভার থাকবে সুপ্রিম কোর্টের ওপর—এই তিনটি অঙ্গীকার নিয়ে বিএনপির আপত্তি ছিল।
ঐকমত্য কমিশন সূত্র জানায়, এই তিনটি ক্ষেত্রে সংশোধনী আনা হচ্ছে। তবে মূল চেতনা ঠিক থাকবে। সরাসরি পুরো সনদকে সংবিধানের ওপরে প্রাধান্য দেওয়ার বিষয়টি বাদ দেওয়া হতে পারে। আর যেহেতু সংবিধানের ব্যাখ্যার ভার সুপ্রিম কোর্টের ওপর, সনদ বাস্তবায়িত হলে এটি সংবিধানের অংশ হবে, তখন এর ব্যাখ্যার ভারও সুপ্রিম কোর্টের ওপর থাকবে। তাই এটি আলাদা করে উল্লেখ করা হবে না।এ ছাড়া সনদের বৈধতা নিয়ে আদালতে প্রশ্ন করা যাবে না, এই বিধানের ক্ষেত্রে ভাষাগত পরিবর্তন আনা হচ্ছে। তাতে বলা হবে, সনদে স্বাক্ষরকারী দলগুলো সনদের বৈধতা নিয়ে কোনো আদালতে চ্যালেঞ্জ করবে না। কখনো এটি চ্যালেঞ্জড হলে স্বাক্ষরকারী দলগুলো এই সনদকে আইনি ও সাংবিধানিকভাবে রক্ষা করবে।
আগামী সপ্তাহে চূড়ান্ত সনদ
কমিশনের এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, গতকালের সভায় রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে পাওয়া মতামত ও পরামর্শগুলো বিশ্লেষণ করা হয়। রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত পর্যালোচনার ভিত্তিতে আগামী সপ্তাহেই বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনায় বসবে কমিশন। এরপর চূড়ান্ত সনদ ও বাস্তবায়নের উপায় সম্পর্কিত সুপারিশ একসঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠানো হবে।
সভায় উপস্থিত ছিলেন কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ, সদস্য বদিউল আলম মজুমদার, বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, সফর রাজ হোসেন ও মো. আইয়ুব মিয়া এবং ঐকমত্য গঠন প্রক্রিয়ায় যুক্ত প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার।