স্টাফ রিপোর্টার:
তিন বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়ার পর বারবার মেয়াদ বৃদ্ধি করে টানা ১৫ বছর ধরে আছেন একই পদে। আওয়ামী লীগ সরকারের দলীয় লেজুড়বৃত্তি করে খুলনা ওয়াসাতে বানিয়েছিলেন নিজস্ব স্বৈরাচারী নিয়ম-কানুন। গত ৫ আগস্ট সরকারের পতনের পর তিনি এখন ভোল পাল্টে হয়ে গেছেন জামায়াতের অনুসারী। উদ্দেশ্য এবার ভিন্ন দলের লেজুড়বৃত্তি করে পুনরায় নিয়োগ পাওয়া। নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির পরও স্বপদে টিকে থাকা মো. আব্দুল্লাহ এখন উঠে পড়ে লেগেছেন খুলনা পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষের (ওয়াসা) ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) পদে পঞ্চম মেয়াদে নিয়োগ পাওয়ার জন্য। খুলনা ওয়াসা সূত্রে জানা গেছে, খুলনা শহরের জন্য পানি সরবরাহের সম্প্রসারণ ও উন্নয়নের লক্ষ্যে ২০০৮ সালের ২ মার্চ খুলনা পানি সরবরাহ এবং পয়ঃনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠা করা হয়। এরপর ২০০৯ সালের ২৫ অক্টোবর প্রথম ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে নিয়োগ পান প্রকৌশলী মো. আবদুল্লাহ। মাসিক আড়াই লাখ টাকা বেতনের এই পদে একবার প্রবেশের পর ধারাবাহিকভাবে তার মেয়াদ শুধু বৃদ্ধিই হয়েছে। প্রথম দিকে ওই পদের জন্য জাতীয় পত্রিকাগুলিতে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হতো।
আর তাতে এমন কিছু শর্ত জুড়ে দেওয়া হতো, যাতে তিনি ছাড়া অন্য কেউ যোগ্য না হন। আর সর্বশেষ ২০২২ সালে নিয়োগের আগে তিনি নিয়ম মোতাবেক কোনো বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ না করে গোপনে বোর্ড থেকে অনুমোদন নিয়ে নিয়েছেন। আগামী ১৬ অক্টোবর তার চতুর্থ দফার নিয়োগের মেয়াদ শেষ হবে।
পদ ধরে রাখতে জামায়াতের অনুসারী:
অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে লেখাপড়া করে মো. আবদুল্লাহ চাকরি করতেন তিতাস গ্যাসে। পানি সম্পর্কে কোনো অভিজ্ঞতা না থাকলেও শেখ হাসিনা সরকারের মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর ঘনিষ্ঠতার সূত্র ধরে খুলনা ওয়াসার শীর্ষ পদে নিয়োগ পেয়েছিলেন তিনি। ওই পদে নিজেকে ধরে রাখতে বঙ্গবন্ধু প্রকৌশলী পরিষদের খুলনার সভাপতির পদ নিয়েছিলেন। তবে গত ৫ আগষ্ট সরকার পতনের পর অন্য ‘সুবিধাবাদীদের সঙ্গে বিপাকে পড়েন এই প্রকৌশলী। তাই পদ বাঁচাতে আঁতাত শুরু করেন বিএনপি ও জামায়াতের সঙ্গে। ওয়াসা থেকে বিভিন্ন সময়ে বহিষ্কার ও পদোন্নতি না পাওয়া বিএনপি ও দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করে দেন। সর্বশেষ গত ২৭ সেপ্টেম্বর বিকেলে খুলনা প্রেসক্লাব ব্যাংকুয়েট হলে জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমানের সুধী সমাবেশে অংশগ্রহণ করেন এমডি মো. আবদুল্লাহ। ওই অনুষ্ঠানের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ফুরফুরে মেজাজে তার অবস্থান ছিল একেবারে প্রথম সা রির চেয়ারে। ২০১৪ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর খুলনা ওয়াসার কর্মকর্তা ও কর্মচারীর জন্য চাকরি প্রবিধানমালা জেগেট হিসেবে প্রণয়ন করা হয়। তাতে সাধারণ আচরণ ও শৃঙ্খলার অধ্যায়ের ২/ক-তে উল্লেখ রয়েছে, কোনো কর্মচারী কোনো রাজনৈতিক আন্দোলনে অংশগ্রহণ, উহার সাহায্যার্থে চাঁদাদান বা অন্য কোনো উপায়ে উহার সহায়তা করিতে পারিবেন না এবং কর্তৃপক্ষের স্বার্থের পরিপন্থি কোনো কার্যকলাপে নিজেকে জড়িত করিবেন না। এ ছাড়া ২/৪-তে উল্লেখ রয়েছে, কোনো কর্মচারী তাহার চাকরি সম্পর্কিত কোনো দাবির সমর্থনে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ বা উহার কোনো কর্মকর্তার ওপর রাজনৈতিক বা বাহিরের কোনো প্রভাব বিস্তার করিবেন না অথবা বিস্তারের চেষ্টা করিবেন না।
এই গেজেটটিও ছিল এমডি মো. আবদুল্লাহর স্বাক্ষরিত। নিজের প্রণয়ন করা প্রবিধানমালা কেন ভঙ্গ করলেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘তারা ডেকেছিল তাই গেলাম- এই আরকি।’ তবে জামায়াতে ইসলামীর খুলনা মহানগরীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল অ্যাডভোকেট শাহ আলম বলেন, ‘ওয়াসার এমডিকে সেখানে কেউ আমন্ত্রণ করেছিল কি না, তা আমার জানা নেই।’
আন্দোলন ঠেকাতে পদোন্নতির আশ্বাস:
খুলনা ওয়াসাকে আওয়ামী লীগপন্থিদের আতুড়ঘর বানিয়েছিলেন এই এমডি আবদুল্লাহ। প্রধান কার্যালয়ের আশপাশে আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে তার ছবি দিয়ে টানানো ছিল ব্যানার ও ফেস্টুন। তবে ৫ আগস্টের পরে বিক্ষুব্ধ কর্মচারীরা তার ছবিসহ ফেস্টুন ছিড়ে ফেলেন।
এরপর থেকে ওয়াসার কর্মচারীরা একত্রিত হয়ে তাকে বাধ্যতামূলক পদত্যাগ করাবেন বলেও যোগসাজশ করেন। তবে ১১ আগস্ট ওয়াসার বিএনপি ও জামায়াত সমর্থকদের সঙ্গে নিয়ে তিনি চেয়ারে বসেন এবং ঘোষণা দেন বঞ্চিতদের পদোন্নতি দেওয়া হবে। একপর্যায়ে গঠন করে দেন পদোন্নতির কমিটিও। ওয়াসার নির্বাহী প্রকৌশলী রেজাউল ইসলাম বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীর পদে কেউ নেই। অথচ ১৪ বছর ধরে আমি একই পদে চাকরি করছি। তবে আমাকে তিনি পদোন্নতি দেননি। একইভাবে সহকারী প্রকৌশলী, উপসহকারী প্রকৌশলীদেরও পদোন্নতি বঞ্চিত করে রেখেছেন। তাই তার বিরুদ্ধে আন্দোলন করা হচ্ছিল।’
পরিবারের নামে গড়েছেন অঢেল সম্পদ:
ওয়াসার এমডির সম্পদ নিয়ে ২০২২ সাল থেকে তদন্ত করে দুর্নীতি দমন কমিশন। দুদকের সহকারী পরিচালক পদমর্যাদার এক ব্যক্তির কাছ থেকে এমডি সম্পদের বিবরণের তথ্য পেয়েছেন এই প্রতিবেদক। তিনি জানান, ঢাকার রমনার সেগুনবাগিচা এলাকার ১১নং ওয়েস্টার্ন টাওয়ারে একটি ফ্ল্যাট রয়েছে এমডি আবদুল্লাহ ও তার স্ত্রীর নামে। এ ছাড়া শ্যামলীর ২নং রোডের ৯/৪নং বাড়িতে চারটি ফ্ল্যাট রয়েছে তার পরিবারের নামে। যার দুটি রয়েছে তার মেয়ের নামে, একটি ভাইয়ের নামে ও একটি নিজের নামে। এর প্রত্যেকটি ফ্ল্যাটের মূল্য প্রায় কোটি টাকার কাছাকাছি। এ ছাড়া শেরপুরের বিসিক নগরীর মেসার্স শ্রাবণ বাধন রাইস মিলটি রয়েছে তার স্ত্রী ও ভাতিজাদের অংশীদারত্বে। জমা রাখা টাকার ব্যাপারে তিনি বলেন, এমডি আবদুল্লাহ ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে আমরা প্রায় কোটি টাকার মতো সঞ্চয়পত্র, জামানত ও চলতি হিসাবের তথ্য পেয়েছি। তবে এ বিষয়ে জানতে চাইলে মো. আবদুল্লাহ বলেন, ‘আমি কোনো দুর্নীতি করি না বলেই তো আমাকে এতদিন একই চেয়ারে রাখা হয়েছে। আপনারা সব সময়ে আমার বিরুদ্ধে অতিরঞ্জিত করে সংবাদ প্রকাশ করেন।’