প্রিন্ট এর তারিখঃ জুলাই ১৮, ২০২৫, ৯:২০ পি.এম || প্রকাশের তারিখঃ জুলাই ১৩, ২০২৫, ৬:০৫ এ.এম
কবিতাঃ- বেহিসাবি হিসাব // ✍🏻 কলমেঃ- বিপ্লব হোসেন

বেহিসাবি হিসাব
দিন দিন খরচের পাল্লাটা ভারি হচ্ছে।
ছেলে মেয়ের স্কুলের বেতন,
তাদের টিউশন-ফি,
যাতায়াত, সবকিছুতেই অতিরিক্ত খরচ গুনতে হচ্ছে।
মাস শেষে বাড়িভাড়া,
অস্বাভাবিক বিদ্যুৎ বিল,
দ্রব্যমূল্যের ক্রমাগত ঊর্ধ্বগতি,
সবকিছু মিলিয়ে নাভিশ্বাস অবস্থা।
এদিকে বাবা মায়ের শরীরটাও ভালো যাচ্ছে না।
মায়ের হার্টের সমস্যা,
প্রায় মাঝে মাঝে ডাক্তার দেখাতে হয়।
টেস্ট করানোর খরচ শুনলে বুকের ভেতর হৃদয়টা যেন কাঁপুনি দিয়ে ওঠে।
ডাক্তারের কাছে যাওয়ার কথা শুনলে মায়ের মুখে চাপা টান,
বলতে চায় না নিজের অসুস্থতার কথা, মা চায় আমি অস্বস্তিতে না পড়ি।
আমি বুঝেও কিছু বলি না,
আমিও শিখে গেছি, চুপচাপ পুড়তে।
প্রতিমাসে প্রয়োজনীয় ওষুধ,
এখন শুধু প্রয়োজন নয়
এটা যেন মাকে সুস্থ রাখার যুদ্ধ।
বাবার এজমার সমস্যা আবার শুরু হয়েছে,
রাতে ঠিকমতো ঘুমাতে পারে না, বাবার একেকটা কাশির শব্দ মনে হয় যেন আমি ভিতর বুকফাটা ঢেউ।
অক্সিজেন মেশিন কিনে ফেলার কথা ভাবি,
যখনই দাম শুনি, তখনই ভাবনা মরে যায়।
তাই নিয়মিত ইনহেলার দিয়েই চালিয়ে নিচ্ছে।
জিজ্ঞেস করলে কিছুই বলতে চায় না, শুধু বলে
"আমি ঠিক আছি তো বাবা"।
আমি প্রতিদিন একটু একটু করে মাঝে মাঝে ভাগ করে দিই নিজেকে,
কখনো বাবার নিঃশ্বাসে,
কখনো মায়ের চিকিৎসায়,
আর বাকি অংশ যেটুকু থাকে তা সংসারের খরচ চুকাতে রাত নেমে আসে। ছেলেমেয়ের ভবিষ্যত?
সে তো উপরওয়ালা জানেন!
বাজারে গেলে কপাল ঘামতে থাকে,
দ্রব্যমূল্যের কথা শুনে মনে হয়, জীবনের অশ্রুগুলোও যেন এখন দামি হয়ে গেছে।
সবজিওয়ালার প্রশ্ন “আর কিছু নেবেন না?”
আর আমি শুনি “আপনি কি নিতে পারবেন কিছু?”
আমার কাছে প্রতিটা বিকেল হয়ে ওঠে শূন্য পকেটের কবিতা।
স্ত্রীর চোখে ঘুম নেই,
চোখের নিচে গাঢ় কালি
আর প্রতিদিনের চিন্তাও কম নয়, কম থাকে শুধু হাসি।
সে তেমন কিছু বলে না,
তার বলার মতো কোনো শব্দ নেই, আর ঠিক সেখানেই বোঝা যায় সংসার কতটা চুপচাপ।
ছেলের স্কুলব্যাগের ছিঁড়ে গেছে।
বললাম, “আর একমাস চালিয়ে নাও।”
মেয়ের জুতো ছোট হয়ে গেছে, পায়ে আটে না।
মেয়েকে জিজ্ঞেস করলাম,
"তোমার জুতো লাগবে?
জবাব দিল না, শুধু মাথা নিচু করল, তার দৃষ্টিতে ছিল চাপা অভিমান,
যা আমাকে সবসময় জ্বালায়।
বাড়িওয়ালার ফোন থেকে
যখন কল আসে,
“ভাড়াটা কবে দেবেন?”
তখন মনে হয়, আমার জীবনের ব্যালেন্স শুধু শূন্য নয়; ঋণাত্মক।
প্রতিদিন ভোরে ঘুম ভাঙে
আলোর জন্য নয়, ভয় থেকে।
আজ আবার কী খরচ আসবে?
বাচ্চার হোমওয়ার্কে মেলাতে গিয়ে ভাবি,
আমার নিজের জীবনেই তো কোনো মিল নেই।
রাতে চুপচাপ জানালার ধারে দাঁড়িয়ে দূরের আলো দেখি,
কিন্তু সেই আলো আমার জীবনের অন্ধকারে পৌঁছায় না।
তবু সকাল হয়,
তবু দাঁড়াই আয়নার সামনে,
মুখে হাসি মেখে যাই জীবন যুদ্ধ করতে।
কারণ আমি বাবা, আমি সন্তান, আমি স্বামী,
আমি একজন জীবিত সংবেদনশীল হিসেবযন্ত্র।
আমি কাঁদি না,
আমি মুখ খুলি না,
আমি শুধু প্রতিদিন বেঁচে থাকার নামে,
একটা আত্মাকে পুড়িয়ে যাই।
Copyright © 2025 cetonaibangladesh.news. All rights reserved.