প্রতিনিধি 19 August 2025 , 4:17:37 প্রিন্ট সংস্করণ
তিন দফা তারিখ পরিবর্তনের পর কুড়িগ্রাম-গাইবান্ধা অঞ্চলের দীর্ঘ প্রতীক্ষিত তিস্তা সেতুটি অসম্পূর্ণ সংযোগ সড়ক রেখেই বুধবার (২০ আগস্ট) উদ্বোধন হতে যাচ্ছে। এটি ১ হাজার ৪৯০ মিটার দীর্ঘ এবং ‘মওলানা ভাসানী সেতু’ নামে পরিচিতি পেয়েছে। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া এটি উদ্বোধন করবেন। সংযোগ সড়কের কাজ শেষ না হওয়ায় চিলমারী অংশের মানুষ তাৎক্ষণিকভাবে এই সেতুর সুফল পাবে না।
তিস্তা নদীর ওপর পিসি গার্ডার কাঠামোয় নির্মিত এই সেতু প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয় গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার পাঁচপীর বাজার থেকে কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলা সদর পর্যন্ত সংযোগ সড়কসহ। ১০ কোটি ৩৩ লাখ ২ হাজার ৮৩২ টাকার এই প্রকল্পের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় ২০২৪ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি। একই বছরের ১৮ ফেব্রুয়ারি কাজ শুরু হলেও নির্ধারিত সময় ২০২৫ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারির মধ্যে তা শেষ করা সম্ভব হয়নি। পরে দুই দফায় সময় বাড়িয়ে নতুন মেয়াদ ধরা হয়েছে আগামী ৩১ ডিসেম্বর। কিন্তু উদ্বোধনের মাত্র এক দিন আগে সোমবার পর্যন্ত চিলমারী অংশের পাঁচ হাজার ২৩০ মিটার রাস্তার মধ্যে কিছু অংশ কার্পেটিং করা হলেও সিংহভাগ কাজই বাকি।
সরেজমিনে দেখা যায়, উপজেলার থানাহাট ইউনিয়নের মাটিকাটা মোড় থেকে চিলমারী সরকারি ডিগ্রি কলেজ মোড় পর্যন্ত কার্পেটিং সম্পন্ন হলেও কলেজ মোড় থেকে মুদাফতথানা সরকারপাড়া পর্যন্ত পুরোনো রাস্তা খুঁড়ে রাখা হয়েছে, যা যানবাহন চলাচলের অনুপযোগী। সরকারপাড়া মোড় থেকে অপু হাজির ইট ভাটা পর্যন্ত রাস্তা পাকা করা হলেও পরবর্তী অংশের কাজ এখনও বাকি। এ বিষয়ে কুড়িগ্রাম এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ ইউনুছ হোসেন বিশ্বাস জানান, এটি একটি প্রকল্পের অধীনে হলেও সংযোগ সড়ক ও সেতুর জন্য আলাদা দুটি স্কিম করা হয়েছে এবং কাজ করছে ভিন্ন ভিন্ন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। সেতুর নির্মাণকাজ ইতোমধ্যেই শেষ হওয়ায় এটি উদ্বোধন করা হচ্ছে। তবে টানা বৃষ্টির কারণে কুড়িগ্রাম অংশের রাস্তার কার্পেটিংয়ের কাজ করতে বিলম্ব হচ্ছে। দ্রুত কাজ শেষ করতে ঠিকাদারকে তাগিদ দেওয়া হচ্ছে।
এদিকে দুই জেলায় নতুন আশায় বুক বাঁধছে তিস্তা পাড়ের মানুষ। একটি সেতু দুই জেলার মানুষকে এক বন্ধনে নিয়ে আসছে। যুগের পর যুগ তিস্তা নদীর দুই পারের মানুষ কত দুর্ভোগ আর বঞ্চনার শিকার হয়েছে। কুড়িগ্রামের উলিপুর, চিলমারী ও গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ, সাদুল্লাপুর উপজেলার তিস্তা পাড়ের কয়েক লাখ মানুষ। চরম কষ্ট থেকে মুক্তি পেতে যাচ্ছে দুই জেলার মানুষ। দীর্ঘদিনের যোগাযোগ ব্যবস্থার সংকটের অবসানে এবার জেগে উঠেছে নতুন সম্ভাবনা। তিস্তা নদীর উপর নব-নির্মিত হরিপুর সেতুটির দ্বার উন্মোচনের পর দুই জেলাবাসীর অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উন্নতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে। কুড়িগ্রামের চিলমারী নৌবন্দর থেকে নদী পথে হরিপুর হয়ে গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ যেতে ২-৩ ঘন্টার উত্তাল নদী পার হতে হয়। সেতু পয়েন্ট থেকে বেলকা বাজার হয়ে সুন্দরগঞ্জ উপজেলা সদর, পাঁচপীর বাজার এবং পাঁচপীর বাজার থেকে ধর্মপুর হয়ে গাইবান্ধা সদর উপজেলার হাটলক্ষ্মীপুর বাজার থেকে সাদুল্লাপুর উপজেলা শহর হয়ে ধাপেরহাট গিয়ে রংপুর-ঢাকা মহাসড়কে সংযোগ। বগুড়া বা ঢাকাগামী চলাচলরত মানুষদের সেতু হওয়াতে সেই পথের দূরত্ব, সময়, শ্রম ও অর্থ সবকিছু কমে আসায় বেজায় খুশি নদী তীরবর্তী বসবাস করা মানুষগুলো।
জানা গেছে, দেশে এলজিইডির ইতিহাসে এটিই সর্ববৃহৎ প্রকল্প। সৌদি সরকারের অর্থায়নে এবং চায়না স্টেট কনস্ট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডের তত্ত্বাবধানে নির্মিত হয়েছে সেতুটি। কুড়িগ্রামের চিলমারী ও গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের মধ্যবর্তী তিস্তা নদীর উপর নির্মিত হরিপুর তিস্তা সেতুর দৈর্ঘ্য ১ হাজার ৪৯০ মিটার (প্রায় দেড় কিলোমিটার) ও প্রস্থ ৯.৬ মিটার। মূল সেতু, কালভার্ট নির্মাণ ও সংযোগ সড়কে এর ব্যয় ধরা হয়েছে ৭৩০ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। এর মধ্যে শুধু মূল সেতুতে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৩৬৩ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। সেতুটির মোট পিলার রয়েছে ৩১টি।
সরেজমিনে দেখা যায়, সেতুটির অভাবে প্রতিনিয়ত চিলমারী তিস্তা পাড়ে বসবাসরত শিশু ও গর্ভবতী নারীদের চিকিৎসার জন্য বিড়ম্বনায় পড়তে হতো। হরিপুর থেকে চিলমারী শহর দূরে হওয়াতে সহজে শহরে চিকিৎসা নিতে পারতেন না নারীরা। বিশেষ করে গর্ভাবস্থায় প্রসব বেদনার সময় অনেক কষ্ট করতে হতো। শুকনো মৌসুমে বাঁশের পালকি করে গর্ভবতী নারীদের পরিবহন করা কষ্টসাধ্য ও ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। আশ-পাশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না থাকাতে চরের শিশুদের ওপারে সুন্দরগঞ্জে পড়তে যেতে হতো। চাকুরিজীবী বাদশা বলেন, ‘আমাকে প্রতি সপ্তাহে গাইবান্ধা থেকে চিলমারী যেতে হতো বাড়িতে। যাত্রী না হওয়া পর্যন্ত বসে থাকতে হতো অনেকক্ষণ আবার কম যাত্রী হলে ভাড়াও দিতে হতো বাড়তি। সেতু হওয়াতে আমার খুব উপকার হবে।’ কুড়িগ্রামের চিলমারী হরিপুর এলাকার বাসিন্দা মনি বেগম বলেন, ‘বর্ষাকালে নৌকায় করে নদী পার হতে সেই ঝুঁকি নিতে হয়। প্রতি বছর কম-বেশি নৌকা ডুবির ঘটনা ঘটে। ব্রিজটা হওয়াতে আমাদের যাতায়াতে খুবই উপকার হবে।’ গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের স্থানীয় ব্যবসায়ী ফারাজি ব্যাপারী বলেন, ‘আমাকে প্রতি হাটে চিলমারী বন্দরে যাওয়া লাগে মালামাল আনতে। কৃষি পণ্য নিয়ে আসতে খুবই দুর্ভোগ পোহাতে হতো। আল্লাহ দিলে এ সমস্যা আর থাকবে না সেতুটি চালু হলে।’ তিস্তা সেতু বাস্তবায়ন আন্দোলনের নেতা আ.ব.ম. শরিয়তুল্লাহ মাস্টার বলেন, ‘২০০০ সাল থেকে তিস্তা সেতু বাস্তবায়ন আন্দোলন শুরু হয়। ২০১২ সালে এসে তিস্তা সেতু নির্মাণ আলোর মুখ দেখতে শুরু করে। এরপর সাবেক তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী শহিদুল ইসলাম প্রামাণিকের সহযোগিতায় ২০১৪ সালে এর নির্মাণ কাজের সূচনা হয়।
এলজিইডি সুন্দরগঞ্জ উপজেলার প্রকৌশলী তপন কুমার চক্রবর্তী জানান, আগামী ২০ আগস্ট নতুন করে হরিপুর সেতুটির উদ্বোধনের দিনক্ষণ নির্ধারণ করা হয়েছে। সবকিছু ঠিক থাকলে সেদিন জনসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হবে এই সেতু। ২০২৪ সালে সেতু ও সংযোগ সড়কের নির্মাণকাজ সম্পন্ন হওয়ার কথা ছিল। পরে নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে তা হয়নি। পরে মন্ত্রণালয় থেকে ০২ আগস্ট তারিখ নির্ধারণ করা হলেও সর্বশেষ আবারও সেটি পিছিয়ে ২০ আগস্ট নির্ধারণ করা হয়েছে। ১ হাজার ৪৯০ মিটার দীর্ঘ সেতুটিতে ২৯০টি পিলারের উপর বসানো হয়েছে ৩১ স্প্যান। নদীর শাসন সহ ব্রিজটিতে খরচ হয়েছে ৪৪০ কোটি টাকা। দু’ধারে সংযোগ সড়ক সহ খরচের পরিমাণ প্রায় ৮০০ কোটি টাকা। এলজিইডি তত্ত্বাবধানে চায়না স্টেট কনস্ট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং কর্পোরেশন কাজটি বাস্তবায়ন করছে। আর এতে অর্থায়ন করছে সৌদি সরকার।