প্রতিনিধি 10 August 2025 , 6:28:13 প্রিন্ট সংস্করণ
খুলনা প্রতিনিধি:
খুলনার রূপসা ট্রাফিক মোড় থেকে খানজাহান আলী সেতু (রূপসা সেতু) পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শিপইয়ার্ড সড়কটি এখন নগরবাসীর গলার কাঁটা। প্রায় এক যুগ আগে মানুষের ভোগান্তি কমাতে এই সড়ক প্রশস্তকরণ ও উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ শুরু হলেও এখনও তা শেষ হয়নি। একদিকে যেমন প্রকল্পের মেয়াদ বারবার বেড়েছে, তেমনি এর নির্মাণ ব্যয়ও বেড়েছে ১৬০ কোটি টাকা। তবুও রাস্তার বেহাল দশা কাটেনি, বরং তা এখন মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, প্রায় ৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সড়কের কোথাও উঁচু, কোথাও নিচু। ইটের খোয়া আর বৃষ্টির কাদা মিলে এক দুর্বিষহ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। যানবাহনগুলো হেলে-দুলে, ব্রেক চেপে গর্ত এড়িয়ে কোনোমতে চলাচল করছে। রাস্তার দুই ধারে জমে আছে পানি, যা পুরো এলাকাকে এক জঞ্জালে পরিণত করেছে।
বাড়ছে মেয়াদ, বাড়ছে খরচ
খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (কেডিএ) ২০১০ সালে এই প্রকল্প হাতে নেয়। ২০১৩ সালের ৭ মে একনেকে অনুমোদন পাওয়ার পর প্রকল্পের মূল ব্যয় ধরা হয়েছিল ৯৮ কোটি ৯০ লাখ টাকা, যা ২০১৫ সালের জুনে শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেই মেয়াদ প্রথমে ২০১৮, তারপর ২০২২ এবং সবশেষে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়। এরপরও কাজ শেষ না হওয়ায় প্রকল্পটি এখনো চলমান। এই দীর্ঘসূত্রিতার কারণে ২০২০ সালে প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে ২৫৯ কোটি ২১ লাখ টাকা হয়, যা মূল বরাদ্দের চেয়ে প্রায় ১৬০ কোটি টাকা বেশি।
প্রকল্পের আওতায় ৩.৭৭৮ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়কটি চার লেনে উন্নীত করা, নতুন ড্রেন, ফুটপাত, একটি সেতু, একটি স্লুইসগেট এবং একটি কালভার্ট নির্মাণ করার কথা। কিন্তু বাস্তবে কাজের গতি এতটাই মন্থর যে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
ঠিকাদার ও কেডিএ’র ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন
খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের একজন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কর্মকর্তা বলেন, “শিপইয়ার্ডের মূল ঠিকাদার মাহাবুব ব্রাদার্স অত্যন্ত প্রভাবশালী। কাজ নিয়ে চাপ দিলে টাকার বান্ডেল চলে আসে। আমরা প্রতিবাদ করতে গেলে অসদাচরণের মামলার ভয়ে চুপ থাকি।” তিনি আরও জানান, রাস্তা নিয়ে কথা উঠলেই ঠিকাদার কিছু শ্রমিক দিয়ে লোক দেখানো খোঁড়াখুঁড়ি করে, আর কর্মকর্তারা এসে রিপোর্ট দেন যে কাজ চলছে।
খুলনা নাগরিক সমাজের সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট বাবুল হাওলাদার জানান, দীর্ঘ এক যুগেও কাজ শেষ না হওয়ার পেছনে দুর্নীতির জনশ্রুতি রয়েছে এবং এর দ্রুত তদন্ত হওয়া দরকার। তিনি বলেন, “সিটি করপোরেশন এবং ওয়াসা সমন্বিতভাবে কাজ করলে হয়তো এই ভোগান্তি এত দীর্ঘ হতো না।”
জনগণের ক্ষোভ ও ভোগান্তি
স্থানীয় বাসিন্দারা চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তৌফিকুল ইসলাম নামের এক বাসিন্দা বলেন, “সড়ক নির্মাণের নামে আমাদের সঙ্গে রসিকতা করা হচ্ছে। কেডিএ হাটেও না, আবার পথও ছাড়ে না। দীর্ঘ দশ বছর ধরে আমরা এই ভোগান্তির শিকার।” বান্দা বাজারের ব্যবসায়ী ইয়াসিন আরাফাত বলেন, “কচ্ছপের গতিতে কাজ চলছে। মাঝেমধ্যে কিছু খোঁড়াখুঁড়ি দেখি। কেডিএ কর্তৃপক্ষের কোনো মাথাব্যথা নেই।”
খুলনা মহানগর বিএনপি সভাপতি শফিকুল আলম মনা বলেন, “১২ বছর ধরে একটি গুরুত্বপূর্ণ সড়ক সংস্কার না হওয়ায় এটি এখন মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে। দীর্ঘসূত্রিতার কারণে প্রকল্পের ব্যয় বেড়েছে, কিন্তু জনগণের ভোগান্তি কমেনি।”
এই বিষয়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মাহাবুব ব্রাদার্সের স্বত্বাধিকারী মাহাবুবুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। অন্যদিকে, কেডিএ’র নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরমান হোসেন এ বিষয়ে তথ্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
গুরুত্বপূর্ণ এই সড়কের দ্রুত সংস্কার না হলে নগরীর যানজট এবং সাধারণ মানুষের ভোগান্তি আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।