বিশেষ প্রতিনিধি, মোঃ মিন্টু:
গাজীপুরের শ্রীপুরে লিমা সরকার (২৫) নামের এক গৃহবধূর রহস্যজনক মৃত্যুর ঘটনায় তাঁর স্বামী ও পেশাদার সংবাদকর্মী রাজিব প্রধানকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। এই ঘটনায় এলাকায় তৈরি হয়েছে চাঞ্চল্য, উঠেছে অসংখ্য প্রশ্ন।
গত ২৯ জুন বিকেল ৫টার দিকে শ্রীপুর উপজেলার কাজীপাড়ার একটি ভাড়া বাসা থেকে লিমার নিথর দেহ উদ্ধার করে পুলিশ। লিমা সিংদীঘি এলাকার বিএনপি নেতা এবিএম হাসানের মেয়ে এবং খিলপাড়া গ্রামের সাংবাদিক রাজিব প্রধানের স্ত্রী।
পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, ২০১১ সালে রাজিব ও লিমার মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। পরিবারের অমতে ২০১৪ সালে বিয়ে করেন তাঁরা। দীর্ঘদিন লুকিয়ে সংসার করার পর ২০২৫ সালে পারিবারিক স্বীকৃতি মেলে। কিন্তু শ্বশুর এবিএম হাসান এই সম্পর্ক কখনোই মেনে নিতে পারেননি। বরং জামাতার বিরুদ্ধে নিজের স্ত্রীর সঙ্গে অবৈধ সম্পর্কের মতো গুরুতর অভিযোগ তোলেন তিনি।
রাজিবের দাবি, তাঁর স্ত্রী মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন। শ্বশুরের অব্যাহত মানসিক চাপ ও অপমানের কারণে লিমা হতাশায় ডুবে গিয়েছিলেন। রাজিব বলেন, “আমি কখনো লিমাকে আঘাত করিনি। আমাদের সম্পর্ক ভালোবাসায় পূর্ণ ছিল। সব সময় চেষ্টা করেছি তাকে আগলে রাখতে।”
লিমা ছিলেন রাগী স্বভাবের, যা রাজিবের ভাষ্যেই স্পষ্ট। ছোটখাটো বিষয়েও রেগে যেতেন এবং রাগের চরম মুহূর্তে মাঝে মাঝে অজ্ঞান হয়ে যেতেন। রাজিব দাবি করেন, “তাঁর পিতার কথাগুলো তাঁকে সবচেয়ে বেশি কষ্ট দিত।”
অন্যদিকে, লিমার পিতা এবিএম হাসান প্রথমে হত্যা মামলা দায়েরের চেষ্টা করলেও ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন না আসায় আত্মহত্যায় প্ররোচনার মামলা দায়ের করেন। তিনি বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত, মাওনা ইউনিয়ন বিএনপির সাবেক সভাপতি।
রাজিবের পরিবারের অভিযোগ, রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে শ্বশুর এবিএম হাসান রাজিবকে একাধিকবার শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেছেন। এমনকি বাড়িতে গিয়ে লাঠি ও জুতার আঘাতও করেছেন। রাজিবের শ্বাশুড়ি প্রথম থেকেই এই সংসার মেনে নিয়েছিলেন। অথচ শ্বশুর তাঁকেও একঘরে করে রাখেন।
স্থানীয়রা বলছেন, পোস্টমর্টেম রিপোর্টের আগেই একজন সংবাদকর্মীকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো ন্যায়বিচারের পরিপন্থী। অনেকের মতে, যদি সত্যিই আত্মহত্যায় প্ররোচনার দায়ে মামলা হয়, তাহলে লিমার শ্বশুরও কম দায়ী নন। কারণ, তিনি এক যুগের সম্পর্ক মেনে নেননি এবং পারিবারিক অশান্তি আরও ঘনীভূত করেছেন।
এদিকে লিমার অকালমৃত্যুতে এলাকায় শোকের ছায়া নেমেছে। বন্ধু ও প্রতিবেশীরা এখনও বিশ্বাস করতে পারছেন না যে হাসিখুশি মেয়েটি এভাবে হঠাৎ চলে যেতে পারে।
মানুষের মুখে মুখে এখন একটাই প্রশ্ন—এটি কি সত্যিই আত্মহত্যা, নাকি এর আড়ালে লুকিয়ে আছে আরও কোনো নির্মম সত্য? স্বজনদের দাবি, এ ঘটনায় কোনো রাজনৈতিক প্রভাব আছে কি না, তা খতিয়ে দেখা দরকার।
দিনশেষে যার প্রিয়জন হারায়, সেই-ই বোঝে এই শূন্যতার গভীরতা। একদিকে শ্বশুর তাঁর ‘রাজকন্যা’কে হারিয়ে শোকাহত, অন্যদিকে রাজিব হারিয়েছেন প্রিয়তমা স্ত্রীকে, আবার মুখোমুখি হয়েছেন অভিযোগের বন্যা ও কারাবরণের নির্মম বাস্তবতার। নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি এখন সর্বমহলের। সত্য উদঘাটনই পারে এই ট্রাজেডির প্রকৃত উত্তর দিতে।
শ্রীপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ আব্দুল বারিক বলেন, “স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে দীর্ঘদিনের মানসিক টানাপোড়েন এবং পারিবারিক বিরোধের জেরে এই ঘটনা ঘটতে পারে। অভিযোগের ভিত্তিতে মামলা হয়েছে এবং রাজিবকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।