গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) পথসভাকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে নিহত ৫ জনের মধ্যে তিন জনের লাশ আদালতের নির্দেশে কবর থেকে উত্তোলন করা হয়েছে। পরে তা পাঠানো হয় গোপালগঞ্জ জেনারেল হাসপাতাল মর্গে।এদিকে, এ সংক্রান্ত মামলায় সাধারণ নিরীহ মানুষকে হয়রানি না করার আহ্বান জানিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেছে জেলা বিএনপি।
গোপালগঞ্জ সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তঅ (ওসি) মীর মো. সাজেদুর রহমান জানান, গোপালগঞ্জে এনসিপির পদযাত্রাকে কেন্দ্র করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে আওয়ামী লীগের সংঘর্ষ হয়। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে পাঁচজন নিহত হয়। এ ঘটনায় গোপালগঞ্জ সদর থানায় চারটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়। মামলা বাদীরা আদালতে নিহতের সুরতহাল প্রতিবেদন ও ময়নাতদন্তের জন্য লাশ উত্তোলনের আবেদন করেন। পরবর্তীতে বিজ্ঞ আদালত ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে নিহত রমজান কাজী, ইমন তালুকদার ও সোহেল রানার লাশ কবর থেকে উত্তোলন করে সুরতহাল প্রতিবেদন ও ময়নাতদন্তের জন্য নির্দেশ দেন।তিনি আরো জানান, সোমবার (২১ জুলাই) দুপুর ১টার দিকে ম্যাজিস্ট্রেট রাসেল মুন্সী ও রন্টি পোদ্দারের উপস্থিততে গোপালগঞ্জ পৌর কবরস্থান থেকে রমজান কাজী ও ইমন তালুকদার এবং টুঙ্গিপাড়ায় ম্যাজিষ্ট্রেট মারুফ দাস্তগীরের উপস্থিততে পারিবারিক কবরস্থান থেকে সোহেল রানা মোল্যার লাশ উত্তোলন করে গোপালগঞ্জ জেনারেল হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়। লাশ উত্তোলনের সময় নিহতের পরিবারের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।তিনি আরো জানান, এর আগে শনিবার (১৯ জুলাই) রাতে সদর থানার চার উপপরিদর্শক (এসআই) বাদী হয়ে গোপালগঞ্জ সদর থানায় চারটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। তিনটি মামলার প্রত্যেকটিতে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে ১ হাজার ৫০০ জনকে ও একটি মামলায় আসামি করা হয়েছে ৯০০ জনকে।গোপালগঞ্জ সদর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আইয়ুব হোসেন বাদী হয়ে রমজান কাজী নিহতের ঘটনায় মামলা দায়ের করেন। এ মামলায় আসামি করা হয়েছে থেকে ৯০০ জনকে।
মামলায় তিনি উল্লেখ করেছেন, গত বুধবার (১৬ জুলাই) এনসিপির শান্তিপূর্ণ সমাবেশ শেষে পৌর পার্ক থেকে দুপুরে মাদারীপুরের উদ্দেশে গাড়িবহর নিয়ে রওনা দিয়ে নেতারা গোপালগঞ্জ শহরের এসকে সালেহিয়া মাদ্রাসার কাছে পৌঁছায়। এ সময় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী এবং দুষ্কৃতকারীরা গাড়ি বহরে দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র ও আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে হামলা করে। পুলিশ, সেনাবাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এতে বাধা দেয়। হামলাকারীরা ক্ষিপ্ত হয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর গুলি চালায়। এ সময় রমজান কাজী (১৭) গুলিবিদ্ধ হয়ে মারাত্মক আহত হন। স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে গোপালগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
মোবাইল ব্যবসায়ী সোহেল রানা মোল্লা নিহতের ঘটনায় বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেছেন একই থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আবুল কালাম আজাদ।মামলায় তিনি উল্লেখ করেছেন, লঞ্চঘাট এলাকায় হোটেল রাজের সামনে আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী ও দুষ্কৃতকারীরা এনসিপির কেন্দ্রীয় নেতাদের ওপর হামলা চালায়। পুলিশ ও সেনাবাহিনী এগিয়ে এলে তাদের লক্ষ্য করে গুলি চালায় তারা। এ সময় সোহেল রানা মোল্লা (৩০) মারাত্মক আহত হন। তাকে উদ্ধার করে গোপালগঞ্জ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
অপরদিকে, সদর থানা পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) শেখ মিজানুর রহমান বাদী হয়ে ১ হাজার ৫০০ জনকে অজ্ঞাত আসামি করে ইমন তালুকদার হত্যা মামলা দায়ের করেছেন।মামলায় তিনি উল্লেখ করেছেন, ঘটনার দিন গত ১৬ জুলাই আসামিরা শহরের পুরাতন সোনালী ব্যাংকের সামনে এনসিপির গাড়ি বহরে হামলা করে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এতে বাধা দিলে দুষ্কৃতকারী আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা গুলি করে। গুলিবিদ্ধ হয়ে ইমন তালুকদার আহত হয়। পরে হাসপাতালে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করে।
নিহত অপর দুইজনের মধ্যে দীপ্ত সাহার মরদেহ হিন্দু ধর্মীয় মতে পৌর শ্মশানে সৎকার ও রমজান মুন্সীর মরদেহের ময়নাতদন্ত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সম্পন্ন করা হয়।নিহত ইমন তালুকরের মামাত ভাই বাবু ভূইয়া ও রমজান কাজীর মামা রানা কাজী জানান, মামলা বিষয়ে তাদের কিছু না জানালেও পুলিশের মাধ্যমে খবর দেয়া হয় লাশ উত্তোলন করা হবে। এ বেশি কিছু জানানো হয়নি। পরে আজ সোমবার (২১ জুলাই) দুপুরে লাশ উত্তোলন করে। গুলি করে কেন মারা হলো এর বিচারের দাবি জানান তারা।
এদিকে, গোপালগঞ্জে এনসিপির নেতাকর্মী ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় দায়েরকৃত মামলায় নিরীহ মানুষকে হয়রানি না করার দাবী জানিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেছে জেলা বিএনপি।আজ সোমবার (২১ জুলাই) দুপুরে শহরের বড়বাজার পৌর মার্কেটে জেলা বিএনপি কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন জেলা বিএনপির আহ্বায়ক শরীফ রফিকুজ্জামান। লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, সম্প্রতি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সংঘর্ষে জনমনে ভীতির সঞ্চার করে। এ সময় বিএনপির বেশ কয়েকটি তোড়ন ভাঙচুর করা হয়। এ সব ঘটনায় কয়েকটি মামলা হয়েছে। এ সময় মামলায় যেন নিরীহ মানুষকে হয়রানি করা না হয়।
এ সংবাদ সম্মেলনে জেলা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সদস্য সচিব কাজী আবুল খায়ের, সদস্য ডা. কে এম বাবর, তৌফিকুল ইসলাম তৌফিক, সদর উপজেলা বিএনপির সভাপতি সিকদার শহীদুল বাসলাম লেলিন, জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক সাজ্জাদ হোসেন হিরাসহ বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের নেতারা উপস্তিত ছিলেন।অপরদিকে, তারেক রহমানের নামে কটূক্তি ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতর অবনতির প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল করে জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দল। বিক্ষোভ মিছিলটি শহরের পুলিশ লাইন্স থেকে শুরু হয়ে কুয়াডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ডে এসে শেষ হয়।
অন্যদিকে, গোপালগঞ্জে ঘটে যাওয়ায় উদ্ভুত পরিস্থিতির উন্নতি হতে শুরু করেছে। জীবনযাত্রাও স্বাবাবিক হতে শুরু হওয়ায় রাস্তায় জনসমাগম বাড়তে শুরু করেছে। কারফিউ ও ১৪৪ ধারা তুলে নেয়ার পর জনমনে কিছুটা হলেও স্বস্তির বাতাস বইছে। তবে গ্রেপ্তার আতঙ্কে যুবকেরাই শুধু নয়, বয়স্ক লোকজনও এলাকা ছেড়ে অন্যত্র পালিয়েছে।আজ সোমবার জেলা শহরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, শহরের বিভিন্ন ওষুধের দোকান, খাবারের দোকানসহ বিভিন্ন দোকান খুলতে শুরু করেছে। অনেকে গ্রেপ্তারের আশংকায় তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলতে সাহস পাচ্ছে না। ঢাকা-খুলনা মহাসড়কে যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক রয়েছে। শহরে আইন-শৃংখলা বাহিনীর তৎপরতা রয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও অফিস আদালত খুলেছে। তবে লোকজনের উপস্থিতি কম। অনেকে তাদের সন্তানকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠাতে ভয় পাচ্ছেন।
১৬ জুলাই গোপালগঞ্জে এনসিপির পদযাত্রা ও পথসভা ভণ্ডুল করতে আওয়ামী লীগ ও ছাত্র লীগের শত শত নেতাকর্মী হামলা চালায়। পরে তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। দিনভর চলা সংঘর্ষে ৫ যুবক নিহত ও পুলিশ-সাংবাদিকসহ শতাধিক মানুষ আহত হয়। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৪ হত্যা মামলাসহ মোট ৮টি মামলা হয়েছে। এতে ৮ হাজার ৪০০ জনকে আসামি করা হয়েছে। আর গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৩১০ জনকে। তাদের মধ্যে দুই শতাধিক আসামিকে বাইরের জেলার কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।