অন্যান্য

গ্রাহকের কোটি কোটি টাকা নিয়ে উধাও ‘বুশরা গ্রুপ’: সাতক্ষীরায় চরম উদ্বেগ!

  প্রতিনিধি 29 July 2025 , 5:05:23 প্রিন্ট সংস্করণ

সাতক্ষীরা, ২৯ জুলাই, ২০২৫:
গ্রাহকের জমা করা কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে লাপাত্তা হয়েছেন সাতক্ষীরার বহুল পরিচিত বুশরা গ্রুপের শীর্ষ কর্মকর্তারা। প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে হাজার হাজার অসহায় গ্রাহকের সর্বস্বান্ত করার অভিযোগ উঠেছে। এই ঘটনার জেরে সাতক্ষীরাজুড়ে চরম উত্তেজনা ও উদ্বেগ বিরাজ করছে।
বুশরা গ্রুপের অধীনে পরিচালিত বুশরা ইসলামী মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লি., বুশরা হাসপাতাল সহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে এই গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। নিখোঁজ কর্মকর্তারা হলেন: বুশরা গ্রুপের চেয়ারম্যান শেখ শরিফুল ইসলাম, নির্বাহী পরিচালক ইকবাল কবির পলাশ এবং পরিচালক আব্দুল্লাহ আল মামুন।
প্রতারণার নতুন কৌশল: লাখে মাসে ২ হাজার টাকা মুনাফার প্রলোভন!
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০০২ সাল থেকে সমবায় অধিদপ্তরের নিবন্ধন নিয়ে বুশরা সমবায় সমিতি তাদের কার্যক্রম শুরু করে। তবে এর আড়ালে তারা এক ভিন্ন খেলায় মেতে ওঠে। প্রতি লাখে মাসে ২ হাজার টাকা মুনাফার লোভনীয় প্রস্তাব দিয়ে সহজ-সরল গ্রামবাসী, দিনমজুর, কৃষক, ব্যবসায়ী এবং চাকরিজীবীদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা আমানত সংগ্রহ করে। কালিগঞ্জ উপজেলা থেকে শুরু হয়ে এই কার্যক্রম জেলাজুড়ে মোট ১২টি অফিসের মাধ্যমে বিস্তার লাভ করে। এমনকি খুলনায় তাদের একটি প্রধান কার্যালয়ও রয়েছে।
সমবায় সমিতি আইন ২০২৩ সংশোধিত অনুযায়ী, ব্যাংকিং কার্যক্রমে জিপিএস, এফডিআর ও সঞ্চয় হিসাব খুলে কোনো গ্রাহকের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহ করা যাবে না। অথচ বুশরা গ্রুপ নির্লজ্জভাবে এই নিয়ম-নীতি লঙ্ঘন করে ‘ইসলামী নাম’ ব্যবহার করে ক্ষুদ্রঋণের নামে অবৈধভাবে কোটি কোটি টাকা সংগ্রহ করেছে। এই অর্থ দিয়ে তারা জমি কিনে প্লট, ফ্ল্যাট বিক্রির ব্যবসা এবং বিজনেস গ্রুপ খুলেছে, যা সম্পূর্ণ বেআইনি।
সর্বস্বান্ত ভুক্তভোগীদের হাহাকার
সোমবার (২৮ জুলাই) সরেজমিনে বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে ভুক্তভোগীদের করুণ চিত্র দেখা যায়। নলতার সম্রাট সু’র মালিক রহমত সাড়ে ৬ লাখ, সোনাটিকারীর স্বপন ৮০ লাখ, জাহাঙ্গীর ৬ লাখ, হাকিম ৫ লাখ, কালীগঞ্জের মুজিব ৫০ লাখ, মিজান ২২ লাখ, আমিন ১৭ লাখ, রশিদ ৪ লাখ, চাঁচাই গ্রামের রাশেদুল ৫০ হাজার, উভাকড় গ্রামের উদ্ভব চন্দ্র ৪ লাখ এবং ভাড়া সিমলার শহিদুল ৮ লাখ টাকা বুশরা গ্রুপে আমানত রেখেছিলেন। এই হাজার হাজার গ্রাহকের কোটি কোটি টাকা এখন অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখে।
কালিগঞ্জ উপজেলার উভাকুড় গ্রামের উদ্ভব চন্দ্র ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “আমি ৪ লাখ আমানত রেখেছি। কয়েক মাস ধরে আমার মূল টাকা ফেরত নিতে কালিগঞ্জ অফিসে যাচ্ছি, কিন্তু টাকা দেওয়া তো দূরে থাক, আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করছে। মাসখানেক ধরে অফিসও খুলছে না।”
একই অভিযোগ পারুলগাছা এলাকার পশু চিকিৎসক সাইফুল ইসলামের। তিনি জমি কেনার জন্য গচ্ছিত ১০ লাখ টাকা আমানত রেখেছিলেন। “প্রায় দেড় বছর ধরে টাকা উত্তোলনের জন্য কালিগঞ্জ ব্রাঞ্চে ঘোরাঘুরি করছি, আজও টাকাটা পাইনি। এখন আমার টাকার কী উপায় হবে?” প্রশ্ন তার। তিনি আরও বলেন, “আমার এলাকার ৩০-৪০ জন লাখ লাখ টাকা আমানত রেখেছে। তারাও টাকা চেয়ে পাচ্ছে না। প্রশাসনের উচিত বুশরার সব সম্পত্তি নিয়ে গ্রাহকদের টাকা ফিরিয়ে দেওয়া।”
কোথায় গেল শত শত কোটি টাকা?
বুশরা গ্রুপে কর্মরত এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, গ্রাহকের আমানতের টাকায় বুশরা গ্রুপের বর্তমানে বুশরা হাসপাতাল, বুশরা পলিটেকনিক ছাড়াও প্রায় ৫০ বিঘার মতো বিরান শ্রেণির জমি রয়েছে, যার সম্ভাব্য মূল্য ৩০ থেকে ৩৫ কোটি টাকা। তবে অবাক করা বিষয় হলো, গ্রাহকের টাকায় কেনা অধিকাংশ সম্পত্তি পরিচালনা পরিষদের কয়েকজন কর্মকর্তার নামে নিবন্ধিত হয়েছে।
চেয়ারম্যান শেখ শরিফুল ইসলামের নামে সাতক্ষীরা ও খুলনা শহরে প্রায় শত বিঘা জমি রয়েছে বলে জানা গেছে। নির্বাহী পরিচালক ইকবাল কবির পলাশ বুশরা গ্রুপের টাকায় নিজ নামে গড়ে তুলেছেন এমআর পরিবহন, যা গত ২৩ জুলাই ভুক্তভোগীরা আটকে দিয়েছিল। এছাড়া তারও রয়েছে জমি, প্লট, ফ্ল্যাটসহ অনেক সম্পত্তি। আরেক পরিচালক আব্দুল্লাহ আল মামুন বুশরার কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। সাতক্ষীরা শহরে তার নামে-বেনামে রয়েছে তিনটি বাড়ি এবং প্রায় শত বিঘা জমি।
কর্তৃপক্ষের বক্তব্য
সাতক্ষীরা জেলা সমবায় কর্মকর্তা এফএম সেলিম আখতার জানান, “বুশরা গ্রুপ আমাদের কাছ থেকে কয়েকটি ছোট সমিতির নিবন্ধন নিয়েছে। তবে তাদের বিভিন্ন ব্যবসা আছে। সম্প্রতি জেলা প্রশাসকের কার্যালয় ও কালিগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয় থেকে বুশরার বিরুদ্ধে কয়েকটি অভিযোগ পাঠিয়েছে। অভিযোগগুলো পর্যালোচনা করে দেখেছি বুশরা গ্রুপ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করেছে। তারা নিবন্ধিত সমিতির বাইরে বিভিন্ন নামে গ্রাহকের টাকা জমা রেখেছে। প্রাথমিকভাবে এসব বিষয়ে বুশরা কর্তৃপক্ষকে সতর্ক করেছি। অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
এই গুরুতর প্রতারণার বিষয়ে জানতে বুশরা গ্রুপের চেয়ারম্যান শরিফুল ইসলাম, নির্বাহী পরিচালক ইকবাল কবির পলাশ ও পরিচালক আব্দুল্লাহ আল মামুনের মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও কোনো সাড়া মেলেনি।
ভুক্তভোগী গ্রাহকরা এখন প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করছেন। তাদের প্রশ্ন, কীভাবে এই প্রতারকচক্র দিনের পর দিন আইনের চোখে ধুলো দিয়ে হাজার হাজার মানুষের টাকা হাতিয়ে নিল?

আরও খবর

                   

জনপ্রিয় সংবাদ