অন্যান্য

জ্বরে পুড়ছে দেশ: করোনার পর ডেঙ্গু-চিকুনগুনিয়ার দ্বিমুখী আঘাত, মিলছে জিকাও !

  প্রতিনিধি 29 July 2025 , 5:15:17 প্রিন্ট সংস্করণ

ঢাকা, ২৯ জুলাই ২০২৫:

রাজধানীসহ সারা দেশে এখন ঘরে ঘরে জ্বর। কখনো তীব্র গরম, কখনো মুষলধারে বৃষ্টি—এই মিশ্র আবহাওয়াই যেন ডেকে এনেছে নানা ধরনের ভাইরাসজনিত জ্বর। তবে এবারের জ্বর শুধু সাধারণ মৌসুমি ফ্লু নয়, এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, করোনা এবং ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো মারাত্মক রোগের আতঙ্ক। বিশেষজ্ঞরা জোর দিয়ে বলছেন, তিন দিনের বেশি জ্বর থাকলেই দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে, কারণ অবহেলা ডেকে আনতে পারে ভয়াবহ বিপদ।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের বহির্বিভাগে দেখা গেল একই চিত্র। ৩৬ বছর বয়সী গাড়িচালক শোভন মিয়া চার দিন ধরে তীব্র জ্বর, সারা শরীরের গিঁটে ব্যথা আর বমিভাবে ভুগছেন। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ৫০ বছর বয়সী মো. মঞ্জুর হোসেনও ছয় দিনের জ্বরে কাবু হয়েছেন। আর ১৩ বছরের ছেলেকে নিয়ে এসেছেন মা জোহরা বেগম, যার জ্বর সাত দিন ধরে।
‘পাঁচ থেকে সাত ধরনের জ্বর ছড়াচ্ছে, ডেঙ্গু এখন ব্যাপক আকার ধারণ করেছে’
বিশিষ্ট মেডিসিন বিশেষজ্ঞ, ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ দৈনিক চেতনায় বাংলাদেশকে বলেন, “আবহাওয়ার পরিবর্তনের কারণে জ্বর হয়েই থাকে। তবে ভাইরাস জ্বরটা বেশি হচ্ছে। সাধারণত সর্দি, কাশি, ঠাণ্ডা লাগা, ইনফ্লুয়েঞ্জা, টাইফয়েড, প্যারা টাইফয়েড, শ্বাসতন্ত্রের ইনফেকশনসহ বিভিন্ন কারণে জ্বর হয়। বিশেষ করে যারা বয়স্ক, ক্রনিক ডিজিজে ভোগেন, বাচ্চা এবং আগে থেকে শ্বাসজনিত রোগে ভুগছেন, তাদের সমস্যাটা বেশি।” তিনি আরও যোগ করেন, “ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া তো আছেই, দু-একটা জিকার কথাও শোনা যাচ্ছে।”
তিনি জোর দিয়ে বলেন, “যেহেতু ডেঙ্গুর সিজন চলছে এবং সারা দেশে ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়েছে, সে কারণে তিন দিনের বেশি জ্বর থাকলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া পরীক্ষা করা জরুরি।” যারা ডায়াবেটিস, লিভারের রোগী, স্ট্রোকের রোগী বা গর্ভবতী নারী, তাদের জ্বর হলে কোনোভাবেই অবহেলা করা যাবে না বলেও তিনি সতর্ক করেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখন মূলত ৫ থেকে ৭ ধরনের জ্বর দেখা দিচ্ছে: ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, করোনা, ইনফ্লুয়েঞ্জা, শ্বাসতন্ত্রীয় সংক্রমণজনিত জ্বর, পানিবাহিত সংক্রমণজনিত জ্বর, এবং কোথাও কোথাও জিকা ভাইরাস সংক্রমণজনিত জ্বর। এসব রোগের সাধারণ উপসর্গ জ্বর ও মাথাব্যথা হলেও, প্রতিটি রোগের রয়েছে নিজস্ব কিছু বিশেষ লক্ষণ।
* ডেঙ্গু: জ্বর, মাথাব্যথার সঙ্গে চোখের অক্ষিগোলকে তীব্র ব্যথা এবং হাড়ে বা অস্থি-সন্ধিতে অসহ্য ব্যথা। হঠাৎ জ্ঞান হারানোর ঘটনা বা রক্তক্ষরণও হতে পারে।
* চিকুনগুনিয়া: জ্বর ১০৪-১০৫ ডিগ্রি পর্যন্ত ওঠে, অস্থি-সন্ধিতে এতটাই তীব্র ব্যথা থাকে যে রোগী হাঁটতেও পারে না। জ্বর চলে গেলেও ১৫-৩০ দিন পর্যন্ত ব্যথা থাকতে পারে।
* করোনা: মাথাব্যথা, শরীর ব্যথা, গলায় ব্যথা বা গলা খুসখুস করে, তবে তা ডেঙ্গু বা চিকুনগুনিয়ার মতো তীব্র নয়। শ্বাসতন্ত্রের সমস্যা বা পেট ফুলে যাওয়াও দেখা যেতে পারে।
* ইনফ্লুয়েঞ্জা: শরীর ম্যাজম্যাজ করা এবং কিছুটা মাথাব্যথা থাকে, যা ডেঙ্গু-চিকুনগুনিয়ার চেয়ে কম তীব্র।
‘জ্বর অবহেলা করলে ভয়ের কারণ হতে পারে’
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী দৈনিক চেতনায় বাংলাদেশকে বলেন, “এই সময়ে যাদের জ্বর হয়, তারা যেনো চিকিৎসকের পরামর্শ নেন। চিকিৎসক রোগীর উপসর্গ শুনে এবং দুই একটা পরীক্ষার মাধ্যমে পরামর্শ দিবেন। এই জ্বরগুলোতে ভয়ের কোনো কারণ নেই, তবে অবহেলা করলে ভয়ের কারণ হতে পারে।”
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন দৈনিক চেতনায় বাংলাদেশকে বলেন, “এই সময়ে নানা কারণে জ্বর হচ্ছে। ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, আর কোভিড অবশ্য কমে গেছে। অন্যরোগে যারা ভুগছেন, যারা বয়স্ক মানুষ, দুর্বল মানুষ, বাচ্চা-শিশু, গর্ভবতী নারী তাদের জন্যে জ্বর চিন্তার কারণ। তাদের জ্বর হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।”
বাংলাদেশ মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটিতে আয়োজিত ‘কনটিনিউইং মেডিক্যাল এডুকেশন (সিএমই)’ সেশনে মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. আবেদ হোসেন খান জানান, এখন জ্বর হলেই মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। কারণ টাইফয়েড, মৌসুমি ফ্লু, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, করোনা—এদের উপসর্গ একে অপরের সঙ্গে মিলে যাওয়ায় মানুষ বিভ্রান্ত হচ্ছে।
চট্টগ্রাম ডেঙ্গু-চিকুনগুনিয়ার উচ্চ ঝুঁকিতে, মিলেছে জিকা ভাইরাসও!
চট্টগ্রাম অফিস থেকে মুহাম্মদ নিজাম উদ্দিন জানাচ্ছেন, জেলায় মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার ঝুঁকি আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। চলতি মাসে ডেঙ্গুতে চারজনের মৃত্যু হয়েছে এবং চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্তের হারও অতিমাত্রায় বেড়েছে। উদ্বেগের বিষয় হলো, সরকারি হাসপাতালগুলোতে এখনো চিকুনগুনিয়া শনাক্তকরণ পরীক্ষা শুরু হয়নি।
আইইডিসিআর-এর গবেষণা প্রতিবেদনে চট্টগ্রাম নগরীকে এডিস মশাবাহিত রোগের জন্য অতি ঝুঁকিপূর্ণ চিহ্নিত করা হয়েছে। গত বছরের জরিপের তুলনায় এবার এডিস মশার প্রজনন ও লার্ভার ঘনত্ব দুটোই বেড়েছে।
এরই মধ্যে জেলায় তিনজনের শরীরে জিকা ভাইরাস শনাক্ত হওয়ার তথ্য দিয়েছে আইইডিসিআর। চিকিৎসকরা বলছেন, জ্বর হলেই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি, যাতে ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, জিকা ভাইরাস নাকি ইনফ্লুয়েঞ্জা হয়েছে, তা শনাক্ত করা সম্ভব হয় এবং রোগী সঠিক চিকিৎসা পায়।
চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসকরা জানান, চিকুনগুনিয়ার রোগীরা জ্বর চলে যাওয়ার পরও ১৫-৩০ দিন পর্যন্ত শরীরে ব্যথায় ভোগেন, যা সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা বা হাঁটাচলায় তীব্র ভোগান্তি সৃষ্টি করে।
চট্টগ্রাম জেলার সিভিল সার্জন ডা. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, “চট্টগ্রামে ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়ার প্রভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে। এখন বর্ষাকাল, বৃষ্টি হচ্ছে। জমে থাকা পানিতে এডিস মশার প্রজনন বেড়েছে। তাই জ্বর হলে সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে। ডেঙ্গু শনাক্ত হলে রোগীকে প্রচুর তরল খাবার খেতে হবে এবং চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনো ওষুধ খাওয়া যাবে না।”
প্রতিরোধের উপায়: পরিচ্ছন্নতা ও সতর্কতা
বিশেষজ্ঞরা জ্বর থেকে বাঁচতে কিছু পরামর্শ দিয়েছেন:
* ঘুমের সময় মশারি ব্যবহার করুন।
* বাড়িঘর পরিচ্ছন্ন রাখুন। বিশেষ করে এডিস মশা জন্মায় এমন স্থানে জমে থাকা পানি নিয়মিত পরিষ্কার করুন।
* মাস্ক ব্যবহার করুন, বিশেষ করে জনবহুল এলাকায় গেলে।
* অন্য অসুস্থ ব্যক্তি থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখুন।
* নিয়মিত সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন।
বর্তমান পরিস্থিতিতে জ্বরকে হালকাভাবে না নিয়ে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।

আরও খবর

                   

জনপ্রিয় সংবাদ