প্রতিনিধি 1 September 2025 , 4:20:59 প্রিন্ট সংস্করণ
এক প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদারের কারসাজিতেই দেশের ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো (এনবিএফআই) এখনো ধুঁকছে। টানা ছয় বছর ধরে লোকসানের বোঝা টানছে পুরো খাত। গত বছর শেষে এই খাতের সামগ্রিক লোকসান বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৫৫৫ কোটি টাকায়।
২০২৩ সালে সব আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সম্মিলিত লোকসানের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৮০৩ কোটি টাকা। সেই হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে পুরো খাতের লোকসান বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে।
ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক খাতের এই দুরবস্থার শুরু মূলত ২০১৪ সালে, পি কে হালদারের হাত ধরে। এক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) পদে বসে তিনি অন্য চারটি প্রতিষ্ঠান নামে-বেনামে নিয়ন্ত্রণ করতেন।
পরে একে একে এসব আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে নামে-বেনামে বিপুল ঋণ বের করে নেন ব্যাংক খাতের ঋণ অনিয়মের জন্য ব্যাপক সমালোচিত এস আলমের এই সহযোগী। পি কে হালদারের অনিয়মের কারণে সংকটে পড়া কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কারণে এখন পুরো খাত ধুঁকছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, দেশে বর্তমানে আর্থিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে ৩৫টি। এর মধ্যে ২২টি দেশীয় মালিকানাধীন। ১৩টি দেশি ও বিদেশি যৌথ মালিকানাধীন।
এর মধ্যে উচ্চ খেলাপি ঋণ ও টাকা ফেরত দিতে না পারা ২০টি প্রতিষ্ঠান কেন বন্ধ করা হবে না জানতে চেয়ে নোটিশ দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যে ১১টি প্রতিষ্ঠান তাদের ঘুরে দাঁড়ানোর কর্মপরিকল্পনা বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা দিয়েছে। বাকি ৯টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান বন্ধের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সরকারের পক্ষ থেকেও এতে সায় এসেছে।
এই ৯টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান বন্ধের পর আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে তহবিল গঠন করার উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
পুরো আর্থিক খাত বিপুল লোকসানে ধুঁকলেও এ খাতের কয়েকটি প্রতিষ্ঠান খুব ভালো করছে ও মুনাফায়ও আছে। এর মধ্যে রয়েছে আইডিএলসি ফাইন্যান্স, আইপিডিসি ফাইন্যান্স, লঙ্কাবাংলা ফাইন্যান্স, ডিবিএইচ ফাইন্যান্স, ইডকল, ইউনাইটেড ফাইন্যান্স, ন্যাশনাল হাউজিংসহ আরও কয়েকটি গত বছর মুনাফায় ছিল।
বাকিগুলো বিপুল পরিমাণ লোকসান করায় পুরো খাতের সম্মিলিত লোকসান সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।
এখন ঝুঁকিতে ২০টি, বন্ধের উদ্যোগ ৯টির
বাংলাদেশ ব্যাংক যে ২০টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে কেন বন্ধ করা হবে না জানতে চেয়ে চিঠি দেয়, সেগুলো হলো সিভিসি ফাইন্যান্স, বে লিজিং, ইসলামিক ফাইন্যান্স, মেরিডিয়ান ফাইন্যান্স, জিএসপি ফাইন্যান্স, হজ ফাইন্যান্স, ন্যাশনাল ফাইন্যান্স, আইআইডিএফসি, প্রিমিয়ার লিজিং, প্রাইম ফাইন্যান্স, উত্তরা ফাইন্যান্স, আভিভা ফাইন্যান্স, ফিনিক্স ফাইন্যান্স, পিপলস লিজিং, ফার্স্ট ফাইন্যান্স, ইউনিয়ন ক্যাপিটাল, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, বিআইএফসি, ফারইস্ট ফাইন্যান্স ও এফএএস ফাইন্যান্স।
এর মধ্যে ৯টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান বন্ধের উদ্যোগ চূড়ান্ত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক, সরকারও এতে সায় দিয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো এফএএস ফাইন্যান্স, বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি (বিআইএফসি), পিপলস লিজিং, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, আভিভা ফাইন্যান্স, প্রিমিয়ার লিজিং, ফারইস্ট ফাইন্যান্স, জিএসপি ফাইন্যান্স ও প্রাইম ফাইন্যান্স।
টানা লোকসানে খাতটি
নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে পুরো আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতে খেলাপি ঋণ বছর বছর বাড়ছে। আর তাতে পুরো খাতের লোকসানও বাড়ছে। ২০১৮ সালে পুরো খাতের খেলাপি ঋণের হার ছিল ৭ দশমিক ৯, যা ২০২০ সালে বেড়ে হয় ১৫ শতাংশ। আর ২০২৪ সাল শেষে তা বেড়ে হয়েছে ৩৩ দশমিক ৮৩ শতাংশ। অর্থাৎ আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিতরণ করা ঋণের এক-তৃতীয়াংশই এখন খেলাপি। সর্বশেষ এই খাত সম্মিলিতভাবে মুনাফা করেছিল ২০১৮ সালে। সেবার এ খাতের সম্মিলিত মুনাফার পরিমাণ ছিল ৮৩০ কোটি টাকা। এরপর ২০১৯ সালে এই খাতের সম্মিলিত লোকসান করে ২ হাজার ২২০ কোটি টাকা। আর ২০২৪ সালে লোকসান আরও বেড়ে হয় ৩ হাজার ৫৫৫ কোটি টাকা।
প্রতিষ্ঠানগুলোর বার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, বিদায়ী বছরে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং ৮৬৩ কোটি টাকা, বিডি ফাইন্যান্স ৭৮৩ কোটি টাকা, বে লিজিং ৪৩৮ কোটি টাকা, আইআইডিএফসি ১৫৮ কোটি টাকা, হজ ফাইন্যান্স ১৩২ কোটি টাকা লোকসান করে। এ ছাড়া সিভিসি ফাইন্যান্স ৪১ কোটি টাকা, মাইডাস ফাইন্যান্স ৩২ কোটি টাকা, মেরিডিয়ান ফাইন্যান্স ৭২ কোটি টাকা, ন্যাশনাল ফাইন্যান্স ৪৩ কোটি টাকা লোকসান করেছে।
অন্ধকারের মধ্যেও আলোর রেখা
পুরো আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাত যখন ডুবছে, তখন এই খাতের কিছু প্রতিষ্ঠান ব্যাংকের সমানতালে মুনাফা করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের করা টেকসই রেটিংসহ আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের মূল্যায়নেও সেরা প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতিও পেয়েছে এ খাতের একাধিক প্রতিষ্ঠান। দেশের অর্থনীতি, বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতের উন্নয়নে এসব প্রতিষ্ঠান জোরালো ভূমিকাও রাখছে। আবার কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান সৌরবিদ্যুৎ খাতে অবদান রাখছে।
যেমন গত বছর শেষে এই খাতের প্রতিষ্ঠান আইডিএলসি ফাইন্যান্স মুনাফা করেছে ২০০ কোটি টাকা। এসএমই ও টেকসই অর্থায়নে পাঁচ বছর ধরে শীর্ষে আছে আইডিএলসি। ভালো ব্যবসার পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানটি এ খাতের নতুন নতুন সেবাও চালু করে চলছে। মোবাইলে আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান বিকাশের মাধ্যমে আমানত সংগ্রহ শুরু করেছে, যা প্রতিষ্ঠানটির সেবাকে প্রান্তিক পর্যায়ে পৌঁছে দিয়েছে। ইতিমধ্যে প্রায় ১৫ লাখ গ্রাহক প্রতিষ্ঠানটিতে সঞ্চয়ী হিসাব খুলেছেন।
যদিও নিজস্ব নেটওয়ার্কের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি ১০ হাজার আমানত গ্রাহক ও ৩০ হাজার ঋণ গ্রাহক পেয়েছে। একই রকম ব্যবসা করে আইপিডিসি ফাইন্যান্স ৩৬ কোটি টাকা ও ইউনাইটেড ফাইন্যান্স ২১ কোটি টাকা মুনাফা করেছে গত বছর।
আবাসন খাতে ঋণ দিয়ে নিজেদের ভিত্তি মজবুত করেছে ডিবিএইচ ফাইন্যান্স। বিদায়ী বছর প্রতিষ্ঠানটি মুনাফা করেছে ১০১ কোটি টাকা। এ ছাড়া ইডকল অবকাঠামো ও সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্ব অর্থায়ন, নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপাদন অর্থায়ন ও জ্বালানি দক্ষতা কর্মসূচিতে অর্থায়ন করে যাচ্ছে। ফলে বিদায়ী বছরে মুনাফা করেছে ১৭১ কোটি টাকা। এ ছাড়া ন্যাশনাল হাউজিং গত বছর মুনাফা করে ২৯ লাখ টাকা।
যেভাবে খারাপ হয়
আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নথিপত্র অনুযায়ী, ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে ও পরে কমপক্ষে চারটি ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের (এনবিএফআই) মালিকানায় অস্বাভাবিক পরিবর্তন আসে। নানা কৌশল করে এসব প্রতিষ্ঠান দখল করেন পি কে হালদার।
প্রতিষ্ঠান দখল করার জন্য নামে-বেনামে অসংখ্য কোম্পানি খোলা হয়, শেয়ারবাজার থেকে বিপুল পরিমাণ শেয়ার কেনা হয়। পরে দখল করা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণের নামে টাকাও সরিয়ে নেন। এমনকি দেশের বাইরেও অর্থ পাচার করে কোম্পানি খোলেন। তার দখল করা প্রতিষ্ঠান চারটি ছিল ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড ও বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি (বিআইএফসি)। সেই চার প্রতিষ্ঠানের আর্থিক অবস্থা এখন চরম খারাপ। আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে পারছে না এসব প্রতিষ্ঠান।
খাতসংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, প্রতিষ্ঠানগুলো দখলের সময় পি কে হালদার প্রথমে রিলায়েন্স ফাইন্যান্স (বর্তমানে আভিভা ফাইন্যান্স) এবং পরে এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের (গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক) এমডি ছিলেন। এই দুই প্রতিষ্ঠান থেকেও বিপুল অঙ্কের অর্থ সরিয়ে নেন তিনি। এসব কাজে তাঁকে সব ধরনের সমর্থন ও সহায়তা দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) তৎকালীন নেতৃত্বের একটি অংশ।
এই দুই নিয়ন্ত্রক সংস্থার নীরবতায় পুরো আর্থিক খাতে ব্যাপক লুটপাটের সুযোগ পান পি কে হালদার। ২০১৯ সালের মাঝামাঝিতে তার দখল করা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো গ্রাহকের টাকা ফেরত দিয়ে ব্যর্থ হতে শুরু করলে পি কে হালদার ভারতে পালিয়ে যান। সেখানে তিনি দেশটির আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তারও হন। দীর্ঘদিন জেল খেটে জামিনে বেরিয়ে এসে তিনি এখন অন্য দেশে পাড়ি দিয়েছেন বলে জানা গেছে।
কী বলছেন সংশ্লিষ্টরা
বাংলাদেশ লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স কোম্পানিজ অ্যাসোসিয়েশনের (বিএলএফসিএ) সাবেক চেয়ারম্যান মমিনুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো দীর্ঘদিন তদারকির বাইরে ছিল। সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ না নেওয়ায় বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠান খারাপ হয়ে গেছে।
এখন একীভূত বা মূলধন জোগান দিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলো ঠিক করতে হবে। পাশাপাশি সঠিক বিধিবিধান দিয়ে খাতটিকে এগিয়ে নেওয়ার পদক্ষেপ নিতে হবে। দেশের আবাসন খাত, দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের ভূমিকা রাখতে পারে এই খাত। আর অর্থের উৎস হতে পারে বন্ড। এ জন্য আইনকানুন সময়োপযোগী করে দিতে হবে।
মমিনুল ইসলাম আরও বলেন, পুরো খাত নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় অনেক ভালো প্রতিষ্ঠানও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ভারতের অর্থনীতিতে যেভাবে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ভূমিকা রাখছে, বাংলাদেশেও একই ভূমিকা রাখতে পারে। এ জন্য যত দ্রুত সম্ভব সিদ্ধান্ত নিয়ে খাতটিকে এগিয়ে নিতে হবে।