অন্যান্য

ট্রাম্প ও নেতানিয়াহু মূলত ‘জেনোসাইড পুরস্কারের’ যোগ্য

  প্রতিনিধি 28 August 2025 , 4:04:51 প্রিন্ট সংস্করণ

ট্রাম্প ও নেতানিয়াহু মূলত ‘জেনোসাইড পুরস্কারের’ যোগ্য
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট শান্তিতে নোবেল পুরস্কার জয়ের স্বপ্ন দেখেন; তিনি দেখেন যে অসলোয় তাঁর হাতে এই পুরস্কার তুলে দেওয়া হচ্ছে। অথচ তাঁর জন্য সঠিক জায়গা হলো হেগে অবস্থিত আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) প্রধান কার্যালয়। দুনিয়ায় ট্রাম্প ছাড়া আর কোনো অ–ইসরায়েলি নাগরিক নেই, যিনি গাজায় রক্তগঙ্গা বইয়ে দেওয়ার জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী। অথচ তিনি যদি চাইতেন, তাহলে একমাত্র তিনিই একটি মাত্র টেলিফোনে এই ভয়াবহ যুদ্ধ থামাতে পারতেন, পারতেন ইসরায়েলি জিম্মিদের প্রাণ রক্ষা করতে।
কিন্তু তিনি তা করেননি। যুদ্ধ থামাতে ফোন করা তো দূরে থাক, ট্রাম্প ইসরায়েলের যুদ্ধযন্ত্রকে নিয়মিতভাবে অর্থ, অস্ত্র ও মদদ দিয়ে যাচ্ছেন, যেন গাজায় কোনো কিছু ঘটেনি। আর তিনি এতেই মোহাচ্ছন্ন হয়ে আছেন। গত সপ্তাহে তিনি বরং ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে একজন ‘সমর নায়ক’ বলে অভিহিত করেন। একই সঙ্গে নিজেও এই সন্দেহজনক সম্মানের ভাগীদার হওয়ার গৌরব ছাড়তে চাননি। তাই ‘আমার তো মনে হয় আমিও তাই’ বলে দাবি করেছেন।
তার মানে গাজায় যে গণহত্যা ঘটিয়ে চলেছে, জেনোসাইড ঘটিয়ে চলেছে, এমন একজনকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বীরযোদ্ধা মনে করছেন! আবার যিনি একবার বর্ষণের জন্য বোমারু বিমান পাঠিয়ে ইরানের বিরুদ্ধে একটি ঝুঁকিহীন অভিযান পরিচালনা করেন, তাঁকেও সমর নায়ক মনে করেন! এই তাহলে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তির মনোভঙ্গি।
ট্রাম্পকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কারের সঙ্গে যুক্ত করার মানে হলো দিনকে রাত বানানো, মিথ্যাকে সত্যি দেখানো। এর আরও মানে হলো এই শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়াবহ যুদ্ধের জন্য অপরাধী ব্যক্তিকে একযোগে নোবেল পুরস্কার জয়ী মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র আর দালাই লামা বানিয়ে ফেলা। ডোনাল্ড ট্রাম্প আর নেলসন ম্যান্ডেলাকে একই নৌকায় তুলে দেওয়া। এহেন চরম উপহাসের কোনো পরিসীমা নেই। আর এই উপহাস করা হতে যাচ্ছে আমাদের ত্যাগের বিনিময়ে।
নেতানিয়াহু ও ট্রাম্প অবশ্য একটি পুরস্কার পেতেই পারেন। সৌভাগ্যবশত কিংবা দুর্ভাগ্যবশত সেই পুরস্কারটা এখনো প্রবর্তিত হয়নি। সেটি হলো ‘জেনোসাইড পুরস্কার’।
দুটি মারাত্মক প্রতিবেদন গত শুক্রবার প্রকাশিত হয়েছে, যেগুলো থেকে এই যুদ্ধের জেনোসাইডমূলক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আর কোনো সন্দেহ থাকে না। জাতিসংঘ সমর্থিত সমন্বিত খাদ্যনিরাপত্তা ধাপ শ্রেণীকরণ (আইপিসি), যা বিশ্বের খাদ্যসংকট বিষয়ে শীর্ষস্থানীয় নির্ভরযোগ্য আভাস প্রদানকারী) নিশ্চিত করেছে যে গাজা নগরীর পাঁচ লাখ মানুষ ও পরিবেশ দুর্ভিক্ষের চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। আর ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) এই ক্ষুধার্ত নগরী দখল নিতে যাচ্ছে। ট্রাম্পও এই নৃশংস দখলদারি অভিযানকে সবুজ সংকেত দিয়েছেন আন্তর্জাতিক সমর্থন ও অস্ত্র দিয়ে।
একই সময়ে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন অনলাইন সাময়িকী +৯৭২ ম্যাগাজিনের হিব্রু সংস্করণ এবং বিলেতের দ্য গার্ডিয়ান ইসরায়েলি সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার উপাত্ত ফাঁস করে দিয়ে দেখিয়েছে যে গাজা যুদ্ধে আইডিএফের হাতে নিহত ফিলিস্তিনির ৮৩ শতাংশই বেসামরিক নাগরিক। এই হার সম্প্রতিকালের সবচেয়ে ভয়াবহ যুদ্ধগুলো যেমন বসনিয়া, ইরাক ও সিরিয়ার যুদ্ধের চেয়েও অনেক বেশি।
তার মানে আইডিএফের নিজস্ব উপাত্ত অনুসারেই যুদ্ধে নিহত প্রতি ছয়জন ফিলিস্তিনির মাত্র একজন বন্দুকধারী ব্যক্তি। আর প্রতি ছয়জনের পাঁচজন হলো নিরীহ বেসামরিক নাগরিক। যাদের বেশির ভাগই নারী ও শিশু। আমরা প্রথমে সন্দেহ করেছিলাম, তারপর জেনে গেছি যে এটা হলো জেনোসাইড। আর পেছনে আছে আমেরিকা।
ট্রাম্প তো এই যুদ্ধ চালাতে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়ে রেখেছেন। তার পরও তিনি শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার দুঃসাহস দেখান। আমেরিকার অনেক মানুষও তাঁদের প্রেসিডেন্টের পিঠ চাপড়াচ্ছে। অথচ হোয়াইট হাউস থেকে একটি মাত্র টেলিফোন করে গাজায় এই নিধনযজ্ঞ থামিয়ে দেওয়া যায়। ব্যাপক ও সর্বাধুনিক গোয়েন্দা যন্ত্রপাতির সম্ভারসহ বিশাল বাজেটের ১৬টি সংস্থা সঙ্গে থাকার পরও ট্রাম্প বলেছেন, তিনি টেলিভিশনে দেখেছেন, গাজায় ‘সত্যিই অনাহার’ ঘটেছে।
কিন্তু টেলিভিশন তাঁকে দৃশ্যত যথেষ্ট মর্মাহত করেনি। তাঁর তো উচিত ছিল ইসরায়েলকে নির্দেশ দেওয়া যে তাৎক্ষণিকভাবে এবং পুরোদমে যুদ্ধবিরতি করা। আবার নেতানিয়াহুর ইসরায়েল বিশ্বরোষ উপেক্ষা করতে পারে না। অথচ গাজায় জেনোসাইড ঠেকাতে অন্য দেশগুলো যখন ইসরায়েলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে যাচ্ছে, তখন ট্রাম্প আবার তাদের বাধা দিতে যা যা করার সবাই করছেন। ইউরোপ তো এগিয়ে এসেছিল; কিন্তু ট্রাম্পের ভয়ে থমকে গেছে, যেমনটা থেমে আছে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো।
ইহুদি আমেরিকান রাজনীতিবিদ রন ডেরমের আবার ইসরায়েলের মন্ত্রিসভার একজন সদস্য। তিনিই হোয়াইট হাউস ও এর ১৬টি গোয়েন্দা সংস্থাকে মিথ্যা বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন যে রক্ত হলো আসলে বৃষ্টি আর এ বৃষ্টি আমেরিকার জন্য আশীর্বাদের। ফলাফল গাজায় উপকূলীয় অবকাশযাপন নগর-পরিকল্পনার পিতা মানে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট এখন পরিণত হয়েছেন একজন স্বঘোষিত কাহনীয়তে (প্রয়াত উগ্র ইহুদি রাবাই মেয়ার কাহনের অনুসারী; যিনি ইসরায়েলে বসবাসকারী সব আরবকে ইসরায়েল ও ইহুদিদের শত্রু অভিহিত করতেন।); আর এ জন্য তিনি আবার শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দাবি করছেন।
গিডিয়ন লেভি ইসরায়েলি সাংবাদিক। হারেৎজ–এ প্রকাশিত লেখাটি ইংরেজি থেকে বাংলায় রূপান্তর করা হয়েছে।

আরও খবর

                   

জনপ্রিয় সংবাদ