প্রতিনিধি 24 December 2024 , 6:04:21 প্রিন্ট সংস্করণ
কামরুল হাসান,সুন্দরগঞ্জ (গাইবান্ধা) প্রতিবেদকঃ
গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে হরিপুর শহরমোড়ে হাতিরঝিঁলের আদলে নির্মাণাধীন ব্রিজের স্প্যান দেবে গেছে। এছাড়া, ১৯টি প্যাকেজ নির্মাণ সম্পন্ন না হওয়ায় তিস্তাসেতু সংযোগ নিয়ে দেখা দিয়েছে বহুমূখী সংশয়।
স্থানীয়রা জানান, গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার চণ্ডিপুর ইউনিয়নের উজানবোচাগাড়ি থেকে হরিপুর ইউনিয়নের হরিপুর মৌজা পর্যন্ত ১৪৯০ মিটার দীর্ঘ তিস্তানদীর উপর নির্মিতব্য তিস্তাসেতু। সেতুটি ২০২৩ সালের জুন মাসে চলাচলের জন্য উম্মুক্ত করার কথা ছিল। সেতুটি উম্মুক্ত হলে বাস্তবায়িত হবে গাইবান্ধা-কুড়িগ্রামবাসীর সেতুবন্ধনের স্বপ্ন। সে স্বপ্ন ভেস্তে গিয়ে সময় বাড়ানো হয় ২০২৫ সালের জুন মাস পর্যন্ত। সেতুটি সংযোগ সংযুক্ত ১৯টি প্যাকেজের কিছুটা এখনো অসম্পন্ন। এছাড়া, উত্তরে চিলমারীগামী সংযোগ সড়কে তিস্তাসেতুর উত্তরপ্রান্ত থেকে ৮’শ মিটার দূরে হরিপুর মৌজায় অবস্থিত শহরমোড় নামক স্থানে তিস্তার একটি শাখানদীর উপর ৯৬ মিটার দীর্ঘ আরেকটি ব্রিজ নির্মাণ কাজ চলছে। ৩৬ মিটার ১টি ও ৩০ মিটার করে ২টিসহ মোট ৩টি স্প্যানে এ ব্রিজটি নির্মাণ ব্যয় হিসেবে ৯ কোটি ৬৬ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। যার, নির্মাণকাল ছিল ২০২১ সালের ১৭ নভেম্বর থেকে ২০২৩ সালের মে মাস পর্যন্ত। নির্ধারিত সময় পেরিয়ে গেলেও এখনো (ডিসেম্বর ২০২৪ পর্যন্ত) একটিমাত্র স্প্যান নির্মাণ করতে না করতেই গত বর্ষাকালে ব্রিজের স্প্যান ৪৪৫ মিলিমিটার দেবে গেছে। গেল বর্ষায় ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রামের ‘নিপা এন্টারপ্রাইজ’র প্রতিনিধি হিসেবে স্থানীয় এক ঠিকাদার তড়িৎগতিতে দায়সারাভাবে ব্রিজটি নির্মাণ কাজ শেষ করতে চেষ্টা চালান। ফলে প্রথমে নির্মিত স্প্যানের মাঝখানে দেবে যায়। এ নিয়ে স্থানীয়দের মাঝে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে।
এব্যাপারে ইউপি চেয়ারম্যান আলহাজ্ব মোজহারুল ইসলামসহ ইউপি’র কতিপয় সদস্য ও স্থানীয়রা বলেন- ব্রিজটি নির্মাণে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রামের ‘নিপা এন্টারপ্রাইজ’র পক্ষে কাজ করছেন অপর এক ঠিকাদার। তিনি অধিক লাভের আশায় নিম্নমানের সামগ্রী দিয়ে দ্রুতগতিতে কোনমতে ব্রিজটি নির্মাণে বরাদ্দকৃত টাকা উত্তোলনের প্রচেষ্টায় দায়সারা কাজ করতে গিয়ে পিলার ও স্প্যান দেবে যায়। এরপর, ধূর্ত ঠিকাদার কৌশল খাটিয়ে যান্ত্রিক পদ্ধতিতে দেবে যাওয়া স্প্যানসহ পিলার উপরের দিকে তুলে সমান করার পায়তারা চালাচ্ছেন। এভাবে ব্রিজটির নির্মাণ কাজ শেষে যোগাযোগের জন্য খুলে দেয়া হলে তা হতে পারে ‘অধিক ঝুঁকিপূর্ণ একটি ব্রিজ’। তাই, তারা ভবিষ্যৎ ঝুঁকিমুক্ত ব্রিজ নির্মাণের দাবি জানান। স্থানীয়রা আশঙ্কা প্রকাশ করে আরো জানান, ১৯টি প্যাকেজ সংশ্লিষ্ট সড়ক ও বক্স কালভার্ট, আরসিসি সেতুসহ প্রকল্পের ৭০ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। তিস্তাসেতুসহ সেতুর উত্তরে নির্মাণাধীন সড়ক রক্ষায় দু’পাশে বসানোর জন্য সিসিব্লক নির্মাণে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার নিম্মমানের সিমেন্ট, নদীর বিভিন্ন চরের বালু তুলে ব্যবহার করছে। এছাড়া, জমি অধিঃগ্রহণ ও ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণে অপর একটি বিভাগের কতিপয় কর্মচারীরও বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ করেন তাঁরা।
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল (এলজিডি) বিভাগসহ একাধিক সূত্র জানিয়েছে, ১৪৯০ মিটার দীর্ঘ ও ৯ দশমিক ৬ মিটার প্রস্থ বিশিষ্ট তিস্তাসেতুর সঙ্গে সুন্দরগঞ্জ-গাইবান্ধা অংশে রয়েছে ১৯টি প্যাকেজ। এরমধ্যে বন্যা ও নদীভাঙ্গণ রোধে বিশেষ ব্যবস্থা (নদী শাসন) ২ প্রান্তে ৪ কিলোমিটার, পাকা রাস্তা ৬০ কিলোমিটার, ব্রিজ ১১টি, কালভার্ট ৩৭টি। এছাড়া, আরো ৮০ কিলোমিটার অতিরিক্ত সড়ক উন্নয়ন, সংশ্লিষ্ট মাটির কাজ, জমি অধিঃগ্রহণসহ সস্পূরক প্রকল্পটি বাস্তবায়নে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৯’শ ২৫ কোটি টাকা। এরমধ্যে দাতা সংস্থা- সৌদী ফাণ্ড ফর ডেভেলপমেন্টের (এসএফডি) প্রদেয় ৬৩২ কোটি ও রাষ্ট্রীয়ভাবে ২৯৩ কোটি। দাতা সংস্থা এসএফডি’র কনসালট্যান্ট হিসেবে নিযোজিত রয়েছেন- এলজিইডির সাবেক প্রকল্প পরিচালক/চীফ ইঞ্জিনিয়ার বীর-মুক্তিযোদ্ধা শহিদুর রহমান প্রামাণিক। তিস্তাসেতুর বৃহৎ প্রকল্পটি নির্মাণে কাজ করছে ‘চায়না ষ্টেট কনস্ট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড’ নামে একটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান।
তিস্তাসেতু সংশ্লিষ্ট সম্পূরক প্রকল্পটির তত্বাবধানে থাকা স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) আশাবাদ ব্যক্ত করছে- এটিই প্রথম বৃহৎ প্রকল্প এলজিইডি’র তত্বাবধানে বাস্তবায়ন হচ্ছে। বর্ধিত সময়সীমা আসন্ন ২০২৫ সালের জুন মাসের মধ্যে সম্পূরক প্রকল্পটি চলাচলের জন্য উম্মুক্ত করে দেয়া হবে। সেতুটি চলাচলে খুলে দেয়া হলে নদ-নদী বেষ্টিত অবহেলিত জনপদ গাইবান্ধা-কুড়িগ্রামের সঙ্গে রাজধানীসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলের সু-নিবির যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রসারিত হবে। এতে লাঘব হবে দীর্ঘ পথের ভোগান্তি। বাঁচবে সময় ও অর্থ। প্রসারিত হবে জীবন-মানের। ঘটবে বিস্ময়কর বৈপ্লবিক বিবর্তন। কিন্তু, নির্মাণ কাজে মন্থরগতির ফলে সময়সীমা অতিক্রম হতেই চলছে। বর্ধিত প্রায় দেড় বছর পূর্তি হলেও শেষ হয়নি তিস্তাসেতুসহ সংযোগ সড়ক, অন্যান্য ব্রিজ, কালভার্ট, নদী শাসনসহ সম্পূরক প্রকল্পের।
অপর একটি সূত্রে জানা যায়, ৩১স্প্যান বিশিষ্ট মূল সেতু নির্মাণ প্রকল্পের আওতায় সেতুর দু’পাশে নদী শাসন, এবাটমেন্ট নির্মাণ কাজ, ৩১টি পিলার ও ১৫৫টি গার্ডার স্থাপন, ১৮ মিটার প্রশস্ত ও ৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়ক নির্মাণ। আর এ জন্য জমি অধিঃগ্রহণও সম্পন্ন হয়েছে অনেক আগেই।
সংশ্লিষ্ট একটি সূত্রে জানা যায়, এরমধ্যে ৫০ কিলোমিটার সড়ক, ব্রিজ ও কালভার্ট নির্মাণের কাজ বাস্তবায়ন করছে উপজেলা স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৩৪ কোটি ৫২ লাখ টাকা। বাকি ৩৬ কিলোমিটার সড়কের কাজ বাস্তবায়ন করছে গাইবান্ধা ও সাদুল্যাপুর এলজিইডি। দীর্ঘতম এ সড়কে বন্যার পানি নিষ্কাশনের জন্য নির্মাণ করা হচ্ছে ১১-১২টি সেতু ও ৫৮টি বক্স কালভার্ট।
এদিকে, হাতিরঝিলের ন্যায় ৯৬ মিটার ব্রিজ নির্মাণে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারে যেভাবে কাজ করছে। তা নিয়ে স্থানীয়দের অভিযোগের অন্তঃ নেই। এব্যাপরে চট্টগ্রামের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান নিপা এন্টারপ্রাইজ’র স্বত্বাধিকারীর সঙ্গে বিভিন্ন সময় কথা বলার চেষ্টা করেও তেমন কোন বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
এলজিইডি’র জেলা নির্বাহী প্রকৌশলী- ছাবিউল ইসলাম, উপজেলা প্রকৌশলী আব্দুল মান্নাফ তিস্তাসেতু সংযোগ সড়কে হরিপুর শহরমোড় নামক স্থানে নির্মিতব্য ৯৬ মিটার ব্রিজের স্প্যান দেবে যাওয়া প্রসঙ্গে পৃথক পৃথকভাবে বলেন- বুয়েটের বিশেষজ্ঞ দলের প্রতিবেদন সাপেক্ষে এ ব্রিজ সম্পর্কে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তাঁরা আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, বর্ধিত সময় ২০২৫ সালের জুন মাসের মধ্যে সম্পূরক প্রকল্প বাস্তবায়ন ও হস্তান্তর করে চলাচলের জন্য খুলে দেয়া যাবে।
এলজিইডি’র অপর এক সূত্রে জানা যায়, সম্পূরক প্রকল্পের জন্য ৯২৫ কোটি টাকার আওতায় রয়েছে কনসালটেন্ট, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-সম্মানী, জমি অধিঃগ্রহণ, স্থাপনা ও জমির মালিকদের ক্ষতিপূরণে প্রদেয় ব্যয়।
এলজিইডি’র প্রকল্প পরিচালক চীফ ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল মালেক এব্যাপারে শনিবার (২১ ডিসেম্বর) বিকালে (২টা ২৪-২৫মিঃ) মোবাইলফোনে এক জবাবে তিস্তাসেতু সংশ্লিষ্ট ১৯টি প্যাকেজ বাস্তবায়নের বিষয়টি নিশ্চিত করে বাদ-বাকী তথ্য জেলা নির্বাহী প্রকৌশলীর নিকট থেকে সংগ্রহের কথা বলেন।
এব্যাপারে আন্তর্জাতিক ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ‘চায়না ষ্টেট কনস্ট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড’র সঙ্গে নানাভাবে যোগাযোগের জন্য চেষ্টা করা হলে তা সম্ভব হয়নি। এমনকি, তিস্তাসেতু পয়েন্টের নিকটবর্তী তাদের ক্যাম্পের (আস্তানা) গেইট পেরিয়ে ভিতরে প্রবেশ করা ও যোগাযোগের সব মাধ্যম নিষেধ বলে জানায় সিকিউরিটি গার্ড।
উত্তর জনপদের অবহেলিত জেলা গাইবান্ধা ও কুড়িগ্রামের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা, চিকিৎসা-সেবাসহ সকল ক্ষেত্রে রাজধানীসহ সাদেশের সবপ্রান্তের সঙ্গে সার্বিক যোগাযোগে বিস্ময়কর বৈপ্লবিক বিবর্তনে উন্নয়ন সাধনের আশাবাদ ব্যক্ত করে সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ দাবি করেন, নদীর স্থানীয় চরগুলোর বালু ও নিম্নমানের সামগ্রীতে সিসিব্লক, ৯৬ মিটার ব্রিজ, সংযোগ সড়ক, নদী শাসনের জন্য তিস্তুাসেতুর ২ প্রান্তে ৪ কিলোমিটার পাকা করণে নির্মাণ কাজে যে অনিয়ম চলছে। এর সুষ্ঠু সমাধান করে যথাযথ প্রকল্প বাস্তবায়ন। তাঁরা আরো বলেন, ইতঃপূর্বে সম্পূরক প্রকল্পের অনিয়মের অভিযোগ করে পুলিশী হয়রাণির শিকার হতে হয়েছে অনেককেই। কেউ কেউ কারাভোগ করেছেন।
উল্লেখ্য, ২০১২ সালে প্রকল্পটি অনুমোদন দেয় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। শিডিউল মোতাবেক অর্থ ছাড় দেয়ার পর ২০১৪ সালের ২৫ জানুয়ারি ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন ও ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয় তিস্তাসেতু নির্মাণ কাজ।