অন্যান্য

নদীর ভাঙা-গড়ার খেলায় ভেসে যায় স্বপ্ন, আতঙ্ক কাটবে কবে?

  প্রতিনিধি 22 August 2025 , 8:22:22 প্রিন্ট সংস্করণ

স্টাফ রিপোর্টার।।

খুলনার দাকোপ উপজেলার বটবুনিয়া এলাকার ষাটোর্ধ্ব গৃহিণী শিখা রানি সরদার। গত পাঁচ বছরে চারবার তার বাড়ি বেড়িবাঁধ ভেঙে তলিয়ে গেছে। তিনবার ঝড়ে আর একবার অতিরিক্ত জোয়ারের চাপে ভেঙে পড়ে বাঁধ। প্রতিবারই ঘরবাড়ির সঙ্গে সব স্বপ্নও নদীতে ভেসে গেছে। কোনো আসবাবপত্রই টিকিয়ে রাখতে পারেননি তিনি। এখন স্বামী ও দুই সন্তানকে নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন সরকারি আশ্রয়ণ প্রকল্পে।

শিখা রানি সরদার বলেন ‘আমার বাড়ি গত পাঁচ বছরে চারবার ভেঙে গেছে। এখন আর নিজের কোনো ঘর নেই, বাধের উপরই থাকতে হয়। দুর্বল বেড়িবাঁধ পানির চাপ বাড়লেই ভেঙে যায়। আমরা চাই শক্ত ও স্থায়ী বাঁধ। না হলে বারবার আমাদের ঘরবাড়ি নদীতে ভেসে যাবে।’

শুধু শিখা রানি নন, খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটের নদী তীরবর্তী অগণিত মানুষ একই দুর্ভোগে দিন কাটাচ্ছেন। খুলনার পাইকগাছার দেলুটি ইউনিয়নের কালিনগর ও হিতামপুর, দাকোপের বটবুনিয়া ও আচাবুনিয়া, সাতক্ষীরার আশাশুনির মরিচ্চাপ নদীর তীরবর্তী অংশ এবং বাগেরহাটের শরণখোলার স্মরণখোলা এলাকাসহ অন্তত ১২টি ইউনিয়নের ২০ কিলোমিটার এলাকায় নতুন করে ভাঙন দেখা দিয়েছে। সব মিলিয়ে অর্ধশত কিলোমিটার বেড়িবাঁধ এখন ঝুঁকিপূর্ণ। যে কোনো মুহূর্তে বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হতে পারে বিস্তীর্ণ জনপদ। এ নিয়ে মানুষের মধ্যে বিরাজ করছে চরম আতঙ্ক।

পাইকগাছার কালিনগরের কৃষক রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘সব সময় ভয় নিয়ে থাকতে হয়। সিগন্যাল দিলে বা নদীতে জোয়ারের চাপ বাড়লে রাতে ঘুমাতে পারি না। কখন যে বাঁধ ভেঙে যায়, এই আতঙ্কে দিন কাটে। আমাদের জীবনে শান্তি নেই, শুধু ভয় আর অনিশ্চয়তা।’

বাগেরহাটের স্মরণখোলার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী আব্দুল হক বলেন, বাঁধ ভেঙে যাওয়ার পর পানি উন্নয়ন বোর্ড সংস্কার করে। কিন্তু সেই কাজ ৬ মাস বা এক বছরও টেকে না। নিম্নমানের কাজ হয়, তাই টেকসই হয় না। কোটি কোটি টাকা খরচ হলেও আমাদের দুর্ভোগ কমে না।’

সাতক্ষীরার আশাশুনির রাশিদা খাতুন বলেন, ‘স্থায়ী ও টেকসই বেড়িবাঁধের দাবিতে আমরা অনেকবার মানববন্ধন, বিক্ষোভ করেছি। কিন্তু আমাদের কথায় কেউ কর্ণপাত করে না। প্রতিশ্রুতি দিলেও কাজের কাজ কিছু হয় না। নদীভাঙন রোধে সঠিক পদক্ষেপ না নিলে আমরা পুরোপুরি হারিয়ে যাব।’

স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের দাবি, নদী ভাঙন রোধে পানি উন্নয়ন বোর্ড শুধু জরুরি সংস্কারের নামে বালির বস্তা ফেলেই দায় সারছে। কিন্তু বর্ষা মৌসুম এলে এসব অস্থায়ী ব্যবস্থা টিকছে না।

দেলুটি ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান সুকুমার কবিরাজ বলেন, ‘আমরা দিনের পর দিন পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাছে দাবি জানিয়ে আসছি, তারা শুধু আশ্বাস দেয় বাঁধ শক্ত করে দেবে, কিন্তু দেয় না। আর যখন সংস্কার হয় তাও নামমাত্র।’

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উপকূলীয় এলাকায় ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড় ও জোয়ারের ফলে নদীর চাপ বেড়ে যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে নদী ভাঙন ও ক্ষয়ক্ষতি দিন দিন বাড়ছে। এখনই টেকসই বাঁধ নির্মাণ না হলে উপকূলের লাখো মানুষ বাস্তুচ্যুত হওয়ার ঝুঁকিতে পড়বে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি বেলার খুলনা বিভাগীয় সমন্বয়কারী মাহফুজুর রহমান মুকুল বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবকে যেমন আমরা অস্বীকার করতে পারব না, তেমনই বসে থাকলেও চলবে না। তাই উপকূলীয় মানুষকে রক্ষায় সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে। এখন যেভাবে বাঁধ মেরামত বা সংস্কার করা হচ্ছে, এটা আসলে কোনো সমাধান নয়। এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব দফতরকে একসঙ্গে কাজ করে গবেষণার মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদী প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে।’

এ বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী মো. আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘যখনই কোন জায়গায় ফাটল বা ভাঙনের খবর আমাদের কাছে আসে তাৎক্ষণিকভাবে জরুরিভাবে সেসব স্থানে মেরামত করা হয়। ভাঙন মোকাবিলায় তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। একইসঙ্গে টেকসই বাঁধ নির্মাণের উদ্যোগও চলছে।’

খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের আওতায় রয়েছে প্রায় ২ হাজার কিলোমিটার বেড়িবাঁধ। কিন্তু প্রকল্প আসা-যাওয়ার মাঝেই নদী তীরবর্তী মানুষের দুর্ভোগ থেকে যাচ্ছে অমীমাংসিত। শত কোটি টাকা খরচ হলেও নদীপাড়ের মানুষের স্বপ্ন ভাঙনের জলে ভেসে যাচ্ছে বারবার। স্থায়ী ও টেকসই বাঁধের দাবি তাদের কণ্ঠে আজ আরও জোরালো।

আরও খবর

                   

জনপ্রিয় সংবাদ