জেমস আব্দুর রহিম রানাঃ অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. ইউনূস নির্বাচনী ট্রেন ছেড়ে দিয়েছেন। কিন্তু নির্বাচনকেন্দ্রিক সংশয় কি কেটেছে? বরং নানান সংশয়ের মধ্যে ড. ইউনূসের নিয়োগকর্তাদের একজন তো গত ১২ আগস্ট গলার রগ ফুলিয়ে ঘোষণা দিয়েছেন, ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে না। তাদের শিরোমণি এক-এগারোর আশঙ্কা জানান দিয়েছেন। এরপরও ধরা যাক নির্বাচন করার ব্যাপারে আমাদের সরকারপ্রধান খুবই আন্তরিক এবং এ ব্যাপারে ধনুর্ভঙ্গ পণ করে আছেন। কিন্তু তার এ ‘আন্তরিক’ বাসনা বাস্তবায়নের জন্য তো অনেক ফ্যাক্টরের ওপর নির্ভর করতে হবে। এর মধ্যে প্রধান হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। আর এ বিষয়ে প্রধান হচ্ছে পুলিশ। পুলিশের ওপর গ্রহণযোগ্য মাত্রায় আস্থা সেই অর্থে কখনোই ছিল না। এখন পুরো দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি মাজুল এবং নানান ঘটনায় পুরো দেশেই পুলিশের ভাবমূর্তি তলানিতে। প্রশ্ন হচ্ছে, এই পুলিশ দিয়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচন কীভাবে হবে? যদিও আমাদের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা আশাবাদী। তিনি সজ্জন ব্যক্তি, আশা তো করতেই পারেন! এ পর্যন্ত ঘোষণা আছে, নির্বাচনে ৮০ হাজার সেনাসদস্য দায়িত্ব পালন করবেন। যদিও দফায় দফায় মেয়াদ বৃদ্ধির ধারায় ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতাসহ সেনাবাহিনী আগে থেকেই মাঠে বহাল। কোনোই সন্দেহ নেই, সেনাবাহিনী মাঠে বিরাজমান না থাকলে পরিস্থিতি হয়তো ভয়াবহ হতো; যা কল্পনা করলেও অনেকের রক্ত হিম হয়ে আসে। এর অর্থ এই নয় যে, বর্তমান অবস্থায় সন্তুষ্ট থেকে নির্বাচন অনুষ্ঠান করা যাবে। বরং সেনাবাহিনীর পাশাপাশি পুলিশ লাগবেই। কিন্তু চলমান পুলিশ দিয়ে কি নির্বাচন অনুষ্ঠানের পুলসুরাত পার হওয়া যাবে? আলামত কিন্তু আশঙ্কার ইঙ্গিত দেয়! প্রসঙ্গত, শেখ হাসিনা পলায়নের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পুলিশের কঠিন সময়ে ৬ আগস্ট রাতে রাজারবাগে অতিরিক্ত আইজিপি এ কে এম শহিদুর রহমান বলেছিলেন, ‘পুলিশে চেইন অব কমান্ড ফেরানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।’ প্রশ্ন হচ্ছে, সেই চেষ্টার বাস্তবায়ন কোন পর্যায়ে আছে? প্রসঙ্গত, শহিদুর রহমান এখন পুলিশে নেই, আছেন অকার্যকর র্যাব। যে র্যাবকে ১১ আগস্ট পলিথিনবিরোধী অভিযানে কাঁচাবাজারে দেখা গেছে। এ ব্যাপারে ঠোঁটকাটা একজনের বাঁকা প্রশ্ন, এলিট ফোর্স র্যাব কি পলিথিন ফোর্সে রূপান্তরিত হয়েছে?
কোনো সন্দেহ নেই, ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকার হটাও আন্দোলন দমনে পৈশাচিক স্বৈরাচার কর্তৃক আদিষ্ট হয়ে পুলিশ যে নৃশংসতা চালিয়েছে এবং পরে নিজেরা যে ভয়াবহ পরিস্থিতির শিকার হয়েছে, তাতে রাষ্ট্রীয় এ বাহিনী ধ্বংসের দোরগোড়ায় চলে গিয়েছিল। সেখান থেকেই টেনে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে। প্রসঙ্গত, ৫ আগস্ট পৈশাচিক স্বৈরাচার শেখ হাসিনা পলায়নের পর সরকার গঠনের আগেই ৭ আগস্ট মধ্যরাতে আইজি, ডিএমপি কমিশনার ও র্যাবের ডিজি পোস্টিং দেওয়া হয়। তবে ‘মধ্যরাতের অশ্বারোহী’ এই ত্রিরত্নের মধ্যে এখন পর্যন্ত সবেধন নীলমণি হিসেবে টিকে আছেন র্যাবের ডিজি এ কে এম শহিদুর রহমান। কিন্তু তার চাকরির মেয়াদ মাত্র মাস দেড়েক আছে বলে জানা গেছে। এদিকে অনেক সত্য ও বানোয়াট অভিযোগের দায় এবং অদৃশ্য খেলার শিকার হয়ে র্যাব এখন বিলুপ্ত আতঙ্কে গুটিয়ে আছে। লাজুক লতার মতো। ফলে প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণা অনুসারে সংসদ নির্বাচন আগামী বছর ফেব্রুয়ারিতে, অথবা অন্য কোনো বছরে অনুষ্ঠিত হলেও সেখানে র্যাব কার্যকর কোনো ভূমিকা রাখতে পারবে বলে মনে হয় না। এদিকে পুলিশের অবস্থা এখনো খুবই মাজুল। এ অবস্থায় আইজি ও ডিএমপি কমিশনার পরিবর্তন করে যে সুফল পাওয়া গেছে, তা আরও এগিয়ে নেওয়া প্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু তেমনটি কি হয়েছে? বরং জোরালো পুলিশে ছোট থেকে বড় উইকেট ফেলে দেওয়ার পালা, যা এখনো চলমান। এটি মনে করার কোনোই কারণ নেই, এরা সবাই নৃশংস শেখ হাসিনার লাটিয়াল হিসেবে জুলাই-আগস্টে মাঠে ছিলেন, অথবা ছিলেন নিয়ন্ত্রকের চেয়ারে। বরং কে কবে কোথায় পোস্টিংয়ে ছিলেন সেই কুষ্ঠিনামা দেখেই ‘ওরে ধর তারে মার’ চলছে বলে অভিযোগ আছে। আর ‘গুঁতাগুঁতি’প্রবণ পুলিশে উইকেট ফেলে দেওয়ার পালা কবে শেষ হবে তাও বলা কঠিন। এই সেদিনও ২৮ জুলাই পুলিশের চার ডিআইজিকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠিয়েছে সদাশয় সরকার। ধরা যাক, উল্লিখিত চার কর্মকর্তা খুবই নাখান্দ ও নালায়েক; তাহলে তাদের বিদায় করতে সরকারের এক বছর সময় লাগল কেন?
বলাবাহুল্য, ক্ষণে ক্ষণে পুলিশের উইকেট ফেলে দেওয়ার কাণ্ডে পুলিশের ওপরমহলে আতঙ্ক বাড়ে। আর যে কোনো বাহিনীই তো ওপরের দ্বারাই চালিত হয়। ওপরের লেভেলেই যদি আতঙ্ক ও অনিশ্চয়তা থাকে, তাহলে তা দিয়ে কি কমান্ড চলে? এ বিষয়টি আর কেউ ভালো না বুঝলেও নিশ্চয়ই অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী হিসেবে প্রতিমন্ত্রী পদমর্যাদায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মরত খোদা বকশ চৌধুরী বুঝবেন। তিনি র্যাবের ডিজি ও পুলিশের আইজি ছিলেন এবং সরকারের জুলুম যে কোন মাত্রার হতে পারে, তা নিজেও ভোগ করেছেন হাসিনা সরকারের আমলে। প্রশ্ন হচ্ছে, তার জন্যও কি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ভূমিকা পালনের পরিবেশ প্রত্যাশিত মাত্রায় নেই? এদিকে বলা হয়, মাঠের পুলিশের নেতৃত্বে যারা আছেন, তাদের কেউ কেউ উটপাখির কৌশলে কোনোরকম টিকে থাকার চেষ্টা করছেন। নিজ নিয়ন্ত্রণে থাকা ইউনিটের কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সাহস পান না। কনস্টেবলের ব্যাপারেও না। যেমন, মাস দুই আগে বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের খোদ কমিশনারের কাছে এক কনস্টেবলের গুরুতর অসদাচরণের বিষয়ে লিখিতভাবে প্রতিকার চেয়েও কোনো ফল পাওয়া যায়নি বলে জানা গেছে। ভুক্তভোগী জনৈক সিনিয়র সাংবাদিক। এটি বিস্ময়কর ঘটনা। এরপর যা জানা গেছে, তা আরও বিস্ময়কর। সব মিলিয়ে বলা যায়, বিরাজমান পুলিশ দিয়ে আগামী জাতীয় নির্বাচন সামলানো হয়তো কঠিন হবে। এদিকে নির্বাচন তো হতেই হবে। যার সময়সীমা ঘেষিত হয়েছে গত ৫ আগস্ট। বর্তমান সরকারের কোনো সাফল্য ঘটনা-দুর্ঘটনা জনগণকে নির্বাচন আকাঙ্ক্ষা থেকে দূরে সরাতে পারবে না। এ ক্ষেত্রে কোনো কিছুকেই নির্বাচনবিরোধী ঢাল হিসেবে ব্যবহারযোগ্য নয়। এমনকি আমেরিকায় পণ্য প্রেরণের শুল্কহার হ্রাসের অকল্পনীয় সাফল্যের সঙ্গে আরও অনেক কিছু যোগ হলেও তা নির্বাচন থেকে দেশকে দূরে রাখার ক্ষেত্রে কার্যকর হবে না। প্রসঙ্গত, ১ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ঐতিহাসিক বাণিজ্য চুক্তি সফলভাবে সম্পন্ন হওয়ার পর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস যথার্থই বলেছেন, ‘এটি বাংলাদেশের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক বিজয়।’ বাংলাদেশের ট্যারিফ আলোচক দলকে আন্তরিক অভিনন্দন জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। দেশের বোদ্ধা জনগোষ্ঠীও অভিন্দন জানাচ্ছেন প্রধান উপদেষ্টাকে। কারণ তার পরিকল্পনায়ই দেশের জন্য এমন বিশাল অর্জন হয়েছে। এটি দেশের অর্থনীতির জন্য স্মরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। এখন একটি অভূতপূর্ব সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান করে স্বর্ণাক্ষরে লেখার মতো আরেকটি চিরস্মরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. ইউনূসকে। তা না হলে তিনি নিজে এবং দেশ মহা-অশান্তিতে পড়বে। কোনো কারণে ড. ইউনূস নির্বাচনের পথ এড়িয়ে চলতে চাইলে সেটি হবে পথ হারানোর নামান্তর। জাতীয় নির্বাচন ছাড়া আর কোনো তাবিজ-কবজ অথবা বাহানা কাজে আসবে না।
অবশ্য নির্বাচনকেন্দ্রিক এ বাস্তবতার বাইরেও গভীরের অন্য কিছু থাকতে পারে বলেও কেউ কেউ মনে করেন। তারা সাম্প্রতিক ঘটনা প্রবাহের দিকে নজর রাখছেন। ‘ট্যারিফ কিং’ হিসেবে খ্যাত ডোনাল্ড ট্রাম্প ভারতের ওপর প্রথম দফায় ২৫ শতাংশ হারে পাল্টা শুল্ক, তার ওপর ‘রাশিয়া পেনাল্টি’ জারির কিছুক্ষণের মধ্যেই পাকিস্তানের সঙ্গে বিরাট এক জ্বালানি সমঝোতার কথা জানিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে ভারতীয় সাবেক রাষ্ট্রদূত কে সি সিং বলছেন, “আসলে চীনের বিরুদ্ধে ভারতকে একটা ব্যালান্সিং ফ্যাক্টর হিসেবে আমেরিকা দেখতে চেয়েছিল বলেই তারা এতদিন ধরে ‘লং রোপ’ দিয়ে এসেছে। মানে ভারতকে ইচ্ছেমতো অনেক কিছু করতে দিয়েছে। কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প অন্য ধাতুর মানুষ। তিনি চাইছেন আমেরিকা চীনের সঙ্গে সরাসরি ডিল করবে, সেখানে মাঝখানে ভারতের কোনো ভূমিকা থাকবে না। এ কারণেই আঞ্চলিক ভূরাজনীতিতে আমেরিকার চোখে ভারতের ভূমিকা অনেকটা খাটো হয়ে গেছে এবং পাকিস্তানকে সামরিক সহযোগিতার হাত বাড়াতেও ট্রাম্প প্রশাসনের আর কোনো দ্বিধা কাজ করছে না। আমেরিকার আরোপ করা চড়া হারে শুল্ক ও তার সঙ্গে অতিরিক্ত জরিমানা ভারতের বৈদেশিক বাণিজ্যের জন্য যেমন বিরাট এক চ্যালেঞ্জ বয়ে এনেছে।”
ওপরে উল্লিখিত প্রসঙ্গটি ধান ভানতে শিবের গীতের মতো শোনালেও গভীর বাস্তবতা তা নয়। বরং উল্লিখিত অবস্থায় বাংলাদেশের ওপর ভারতের মাতব্বরিতে কিছুটা নয়, অনেকটাই টান পড়বে। বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারত আর ‘ছাড়া গরু’ অবস্থায় নেই। কারণ চীনের ব্যাপারেই যদি ভারতকে আমেরিকা কাঠের চশমা দিয়ে না দেখে, তাহলে বাংলাদেশকে ভারতের চশমা দিয়ে দেখবে কেন? ফলে ইউনূস সরকারের বিরুদ্ধে ট্রাম্পকার্ড হিসেবে শেখ হাসিনাকে ব্যবহার করা ভারতের জন্য আগের চেয়ে অনেক জটিল হয়ে গেছে বলে মনে করছে পর্যবেক্ষক মহল। এটি নিঃসন্দেহে ইউনূস সরকারের জন্য একটি আনন্দের সংবাদ। কিন্তু এ আনন্দে বগল বাজাবার তালে থাকলে বিপদ কিন্তু হঠাৎ চলে আসতে পারে। যেমন এসেছিল শেখ হাসিনার জন্য। আর বিপদ আসুক আর নাই আসুক, নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিকল্প কিছু বিবেচনা করলে দেশ এবং ড. ইউনূসের জন্য কোনো সুফল আসবে না। এমনকি মালয়েশিয়া সফরের সাফল্যও নয়। এরপরও মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন হচ্ছে, এ নির্বাচন কীভাবে হবে? কী দিয়ে হবে? তাহলে কি ইউনূস সরকার প্রলম্বিত হবে? এ প্রসঙ্গে এক আড্ডায় একজন সিনিয়র আইনজীবী বলেছেন, বিশ্ব মোড়ল আমেরিকা জনপ্রিয় সরকার পছন্দ করে না। কেননা, অজনপ্রিয় সরকারের মাধ্যমে নানান সুবিধা নেওয়া সহজ হয়। আরও অনেক বাস্তবতার রেশ টেনে উল্লিখিত আইনজীবী বলেছেন, লাইন নাজুক হলে বগি কমিয়ে যেমন ট্রেন চলে তেমনই সরকারের সাইজ ছোট এবং প্রয়োজনীয় সংযোজন ও সংস্কার করে হলেও ড. ইউনূসকে সামনে রেখেই আরও কিছুদিন সরকার চলতে পারে, অন্তত আরও দুই বছর। তা না হলে ‘যে লাউ সেই কদু’ থেকে যাওয়ার আশঙ্কাই প্রবল!