তোফাজ্জল ইসলাম
চৈত্র মাসে মধুকৃষ্ণা ত্রয়োদশী তিথিতে যাদুকাটায় এসে স্নান করলে সব পাপ মোচন হয়, এজন্য এখানে এসেছি গঙ্গাস্নান করে পুণ্যলাভ করতে। বলছিলেন, সূর্যে্যরগাঁও গ্রামের অনির্বাণ দাস। তিনি বলেন, পরিবারের সবাই একত্রিত হয়ে পণাতীর্থে গঙ্গাস্নান করতে এসেছি। গঙ্গাস্নানের পাশাপাশি অনেকে এখানে আসেন মা, বাবা, আত্মীয়—স্বজনের অস্থি বিসর্জন দেওয়ার জন্য। আমিও বাবার অস্থি বিসর্জন দিতে এসেছি।
তাহিরপুর উপজেলার রাজারগাঁও শ্রী অদ্বৈত প্রভুর জন্মধাম সংলগ্ন যাদুকাটা নদীতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত ও বিদেশ থেকে আগত ভক্তদের অংশগ্রহণে পণাতীর্থ গঙ্গাস্নান সম্পন্ন হয়েছে। মধুকৃষ্ণা ত্রয়োদশী তিথিতে বুধবার রাত ১১টা ১ মিনিট ৫৩ সেকেন্ড থেকে শুরু হয় গঙ্গাস্নান। গঙ্গাস্নানের আনুষ্ঠানিকতা চলবে আজ বৃহস্পতিবার (২৭ মার্চ) রাত ৯টা ২৪ মিনিট ৩২ সেকেন্ড পর্যন্ত। দুইদিন ব্যাপী পণাতীর্থ গঙ্গাস্নান ও বারুণীমেলায় নামে লাখো মানুষের ঢল। এলাকায় সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে বিরাজ করে উৎসবের আমেজ।
বুধবার সকাল থেকেই লাখো মানুষ অদ্বৈত প্রভুর আখড়া, গড়কাটি ইসকন মন্দির এবং নদীর তীরে অবস্থান নেন। আগত ভক্ত ও দর্শনার্থীদের মধ্যে মহাপ্রসাদ বিতরণ করা হয়। রাজারগাঁও আখড়াবাড়ি ও যাদুকাটা নদীর উভয় তীরে বালুর চরে বসে মাটির খেলনা, খাদ্যসামগ্রীর দোকান। ছিল নাগরদোলাও।
তেরীগাঁও গ্রামের বিশিষ্ট কয়লা আমাদানীকারক শীতেশ পাল বলেন, কেউ যান লাঙ্গলবন্দে, কেউ যান ভারতের গঙ্গায়, আর কেউ মনে করেন সব তীর্থের সেরা তীর্থ পণাতীর্থ।
পুণ্যার্থী শ্যামল বর্মণ বলেন, চৈত্র মাসের মধুকৃষ্ণা ত্রয়োদশী তিথিতে গঙ্গা, যমুনা, সরস্বতী সহ সাত পুণ্য নদীর প্রবাহ একসঙ্গে যাদুকাটায় এসে মিলিত হওয়ায় নদীর জল পবিত্র হয়ে উঠে।
চৈত্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের ত্রয়োদশী তিথিকে বারুণী যোগ বলা হয়। যদি ত্রয়োদশী তিথির সঙ্গে শতভিষা নক্ষত্র যোগ হয়, তবে সেটাকে মহাবারুণী যোগ বলা হয়। প্রতি বছর চৈত্র মাসে তাহিরপুর উপজেলার বাদাঘাট ইউনিয়নের যাদুকাটা নদীর রাজারগাঁও সংলগ্ন স্থানে গঙ্গাস্নান অনুষ্ঠিত হয়। ভক্তরা এখানে তর্পণও (পিতৃপুরুষের বিদেহী আত্মার শান্তির জন্য) করেন।
আনুমানিক ১৪৩৪ খ্রিস্টাব্দের মাঘ মাসে শ্রী শ্রী অদ্বৈত আচার্য তাহিরপুর উপজেলার লাউড় পরগণার অন্তর্গত নবগ্রামে আবির্ভূত হন। তবে নবগ্রাম যাদুকাটার নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে বহু আগেই। বর্তমানে অদ্বৈত আচার্য প্রভুর মন্দির গড়ে উঠেছে নবগ্রাম সংলগ্ন রাজারগাঁওয়ে।
‘অদ্বৈত প্রকাশ’ উল্লেখ রয়েছে, একদিন রাত্রিতে অদ্বৈত জননী নাভাদেবী স্বপ্নে দেখেন যে, তিনি নানা তীর্থ জলে স্নান করছেন। প্রভাতে তিনি স্বপ্নের কথা স্মরণ করে ও তীর্থ গমনের নানান অসুবিধার বিষয় চিন্তা করে বিমর্ষ হয়ে পড়েন। এমন সময়ে পুত্র অদ্বৈতাচার্য সেখানে উপস্থিত হয়ে মাতার বিমর্ষতার কারণ জিজ্ঞাসা করলে তাঁর মাতা তাঁকে স্বপ্ন দর্শনের কথা অবহিত করেন এবং তীর্থযাত্রায় অপারগতার কথা প্রকাশ করেন। অদ্বৈাতাচার্য মাকে বিষন্ন দেখে পণ করলেন যে, এই স্থানেই সকল তীর্থের আবির্ভাব করাবেন। অদ্বৈতাচার্য মন:শক্তির অসীম প্রভাব ও যোগবলের অসাধারণ শক্তিতে তীর্থ সমূহকে আকর্ষণ করে লাউড়ের এক শৈলের উপর আনয়ন করেন। অদ্বৈত জননী তাতে স্নান করে পরিতৃপ্তা হলেন। এইভাবে এই তীর্থের উৎপত্তি হয়। অদ্বৈতের ন্যায় তীর্থ সমূহও পণ করেছিলো যে, প্রতি বারুণীতেই এই স্থানে তাঁদের আবির্ভাব হবে। এই পণ শব্দ থেকেই নাম হয়েছে পণাতীর্থ।
অদ্বৈত জন্মধাম পরিচালনা কমিটির সভাপতি করুনা সিন্ধু চৌধুরী বাবুল বলেন, দুইদিন আগে থেকেই উৎসবে আগত পুণ্যার্থীরা এখানে অবস্থান করে গঙ্গাস্নান সম্পন্ন করেছেন।
তাহিরপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. আবুল হাসেম বলেন, পণাতীর্থ গঙ্গাস্নানে আইন শৃঙ্খলা রক্ষায় ৩ জন নির্বাহী ম্যাজিস্টেট, ৫ শতাধিক পুলিশ, আনসার ও গ্রাম পুলিশ মোতায়েন করা হয়। যাদুকাটা নদীর উভয় তীর সিসি ক্যামেরা দ্বারা সার্বক্ষণিক নজরদারীতে রাখা হয়েছে। কোন ধরনের বিশৃঙ্খলা ও আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটেনি।