এস চাঙমা সত্যজিৎ
বিশেষ সংবাদদাতাঃ
বাংলাদেশের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলের পার্বত্য চট্টগ্রাম একটি কিংবদন্তী নক্ষত্রের সম্মোহনী শক্তির পতন ঘটলো। গতকাল রাতে পার্বত্য চট্টগ্রামের সাংবাদিকতার পথিকৃৎ, সংবাদের কিংবদন্তী এ কে এম মকছুদ আহমেদ ভাই (৮০) আশি বছর বয়সে আমাদের ছেড়ে এক অদৃশ্য শক্তির বলয়ে চলে গেলেন। (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইলাহি রাজিউন)। আজ তাঁর জানাজা রাঙামাটি প্রেসক্লাবের সামনে করা হবে। পরে তাঁর রাঙামাটির শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন করা হবে।
আমি এ কে এম মকছুদ আহমেদের সর্বপ্রথম সাপ্তাহিক বনভূমি পত্রিকায় ১৯৭৮ সালে যোগদান করি। এতে আমার চাঙমা কবিতা, গল্প, সংবাদ লেখার মধ্য দিয়ে সাংবাদিকতার হাতে খড়ি। এরপর এ কে এম মকছুদ আহমেদের সম্পাদনা ও প্রকাশনায় প্রকাশিত দৈনিক গিরি দর্পণ পত্রিকায় যোগদান করি। আজ এ কে এম মকছুদ আহমেদ বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ৯টায় অদৃশ্য শক্তির বলয়ে ইহলোকে ত্যাগ করে পরলোক গমন করেন। তাঁর সেই সংবাদের ভিত্তিতে আজ আমি সততা ও নিষ্ঠার সাথে সংবাদপত্রের জগতে অকুতোভয় সাহসীকতার সহিত বিচরণ করছি। তাই আমি তাঁর কাছে আজীবন ঋণী হয়ে থাকব। আজীবন কৃতজ্ঞতায় তাঁর পাশে থাকব বলে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ রয়েছি। তাই আমি তাঁর প্রয়াণকালে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করি, এ কে এম মকছুদ আহমেদ ভাই যেখানে যান না কেন সুখ শান্তি ও আনন্দঘন পরিবেশে প্রতিকূলে থাকুন।
আজ আমি "চাঙমা ফুগুরি হালাম'র পক্ষ থেকে এ কে এম মকছুদ আহমেদের প্রয়াণে গভীর সমবেদনাসহ শ্রদ্ধাঞ্জলী নিবেদন করছি এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করছি।
এ কে এম মকছুদ আহমেদের জন্মঃ
তিনি ১৯৪৫ সালে ১০ জুলাই চট্টগ্রামের মিরসরাই উত্তর মগাদিয়া গ্রামের মরহুম জামাল উল্লাহ ও মরহুমা জামিলা খাতুনের ঔরসে ও গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি অবিভক্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার (খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও বান্দরবান, চট্টগ্রামসহ) ১৯৬৯ সালে প্রথম সাংবাদিকতায় ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় যোগ দেন। শুরু হয় সাংবাদিকতা পেশায় একজন প্রবীণ সাংবাদিক এ কে এম মকছুদ আহমেদ। তিনি এমন এক সময়ে প্রয়াণ করলেন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস মহান একুশে ফেব্রুয়ারী দিনের শুরুর আগ মুহূর্তে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের সংবাদ পাঠকের কাছে ছড়িয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে যে নেপথ্য পুরুষের নাম প্রোথিত রয়েছে তিনি এ কে এম মকছুদ আহমেদ। একজন শক্তিমান, নিষ্ঠাবান, সংবাদ প্রিয় সাংবাদিক।
অবর্ণনীয় কষ্টের মধ্যেও নিয়মিত সংবাদ প্রেরণে মকছুদ আহমেদ এর অস্থিরতা পাঠকের কাছে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়েছে। আধুনিক যোগাযোগের সুযোগ সামান্যও ছিল না। ফোন ছিল পুরনো মডেলের। যানবাহনে দীর্ঘ যাত্রা। কিন্তু তবুও সংবাদ প্রেরণে তাঁর বিরামহীন চলা অগ্রগণ্য।
এ কে এম মকছুদ আহমেদ সম্পাদিত সাপ্তাহিক বনভূমি পত্রিকাই প্রথম নিয়মিত সংবাদপত্র যা পাহাড়ের খবর অপরাপর অঞ্চলের মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছে, সুখ দুঃখ সমস্যা সম্ভাবনা চিত্র তুলে ধরেছে। বনভূমির আবেদন এখনো বিস্তৃত। এরি পথ ধরে দৈনিক গিরি দর্পণের আত্মপ্রকাশ। এই দুই সংসদপত্র পার্বত্য অঞ্চলের মানুষের মাঝে সংবাদ বিনিময়ে শক্ত বন্ধন রচনা করতে সক্ষম হয়েছে বলা যায়। গিরি দর্পণ ও বনভূমির অনুপ্রেরণায় এবং পত্রিকার নিজস্ব প্রয়োজনে তিন পার্বত্য জেলায় সাংবাদিকতায় এসেছেন বহু তরুণ। এ ধারাবাহিকতায় পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রতিটি জেলায় আজ দৈনিক সংবাদপত্র প্রকাশ হচ্ছে। সংবাদপত্রের বিকাশ ঘটেছে। সংবাদের ধারা বিকশিত হয়েছে। সাংবাদিকতা পেশা এক ঝাঁক তরুণের হাতে বিকশিত ফুলের মতো সাজিয়ে দিয়েছেন জেলা উপজেলায়। এসবই তাঁর অনুপ্রেরণায়। এ কে এম মকছুদ আহমেদ আজ পার্বত্য চট্টগ্রামের সংবাদপত্রের জগতে এক অমর পথিকৃৎ। তিনি সাহস করে পত্রিকা প্রকাশ না করলে পাহাড়ে সংবাদের গতিশীলতা হয়তো আরো ধীরে বৃদ্ধি পেতো। সাংবাদিক, সংবাদপত্রের আত্মপ্রকাশ ঘটতো আরো ধীরে। পার্বত্য অঞ্চলে সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার বিকাশ ও উন্নয়নে এ কে এম মকছুদ আহমেদের অকৃত্রিম, নিবেদিত, নিবিড় অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ দৈনিক অরণ্য বার্তা সম্মাননা পদক ২০০১ প্রদান করেছে। সাথে আমাকেও সম্মাননা পদক দেয়া হয়েছে। তাই এ কে এম মকছুদ আহমেদ ভাই পার্বত্য চট্টগ্রামে সংবাদপত্র প্রকাশ না করলে হয়তো আমি এই পদক থেকে বঞ্চিত হতে হতো। সেজন্য আমি আজ তাঁর প্রয়াণকালে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করি, মকছুদ আহমেদ ভাই যেন পরপারের যে কোন স্থানে শান্তির আস্তানায় থাকেন।
এক সময় পার্বত্য চট্টগ্রামে যখন সংবাদপত্র প্রকাশ করা কঠিন ছিল। ছিল দুঃসাধ্য। সে সময় শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের অনুপ্রেরণায় সাহস করে এ কে এম মকছুদ আহমেদ ভাই ১৯৭৮ সালে সাপ্তাহিক বনভূমি প্রকাশ করেছিলেন।
এ কে এম মকছুদ আহমেদের জন্ম চট্টগ্রাম জেলার মিরসরাই উপজেলার উত্তর মগাদিয়া গ্রামে ১৯৪৫ সালে। চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের মরহুম জামাল উল্লাহ ও মরহুমা জামিলা খাতুনের পুত্র। তিনি প্রথমে ছিলেন একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। পরে ১৯৬৯ সালে দৈনিক আজাদীর রাঙামাটির প্রতিনিধি হিসেবে সাংবাদিকতার কাজ শুরু করেন। এ ছাড়াও তিনি দৈনিক জনপদ (১৯৭৩), দৈনিক পূর্বদেশ (১৯৭৪), পরে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৮৬ থেকে অদ্যাবধি দৈনিক ইত্তেফাক জেলার দায়িত্ব পালন করেছেন। এরি ফাঁকে ১৯৮৩ থেকে ১৯৯৮ পর্যন্ত ১৫ বছর বিবিসির ষ্ট্রিংগার ছিলেন। তিনি সম্পাদক ও সাংবাদিক বিষয়ে বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটের প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। ১৯৯০ সালের আমেরিকান বায়োগ্রাফিক্যাল ইন্সটিটিউটের পৃথিবীর পাঁচ হাজার বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ত্ব নামক বইতে এ কে এম মকছুদ আহমেদের জীবনী ছাপানো হয়েছে। তিনি বহু সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও সেবামূলক সংগঠনের সাথে জড়িত ছিলেন। আজ আমরা পার্বত্য চট্টগ্রাম তথা বাংলাদেশের এক অম্লান উজ্জ্বল নক্ষত্রের সম্মোহনী শক্তির উৎস হারিয়ে ফেলেছি।
এ কে এম মকছুদ আহমেদ ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রামের সংবাদপত্রের জগতে এবং সাংবাদিকতার পথিকৃৎ ও এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, এক অপ্রকাশিত সংবাদের ইতিহাস, সংবাদের কিংবদন্তী।