প্রতিনিধি 3 September 2025 , 6:32:38 প্রিন্ট সংস্করণ
কেউ ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মেয়ে, কেউ কৃষকের সন্তান, কেউ শ্রমজীবী পরিবারে বড় হওয়া। কারও শৈশব কেটেছে আধপেটা খেয়ে, কারও অন্যের জমিতে। তবু স্বপ্ন থেমে থাকেনি। পড়াশোনাই ছিল একমাত্র ভরসা, একমাত্র বিনোদন।
এমন সংগ্রামের মধ্য দিয়েই এবার এসএসসিতে জিপিএ–৫ পেয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জের সিমতি মুরমু, সুনামগঞ্জের জনিক মিয়া, ফরিদপুরের ঈশিতা খাতুন আর লালমনিরহাটের বর্ষা রানী। প্রতিকূলতার ভেতর থেকেও তারা দেখিয়েছে অদম্য মেধার ঝলক।
পড়াশোনাই একমাত্র বিনোদন সিমতির
সকালে একমুঠো চালভাজা আর একবাটি লবণ–চা। বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যায় গরম ভাত। এ–ই হচ্ছে অভাব-অনটনে থাকা সাঁওতাল জাতিসত্তার পরিবারগুলোর সাধারণ চিত্র। এমন একটি পরিবারের মেয়ে সিমতি মুরমু। নিত্য ক্ষুধা-দারিদ্র্য মোকাবিলা করেই বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছে সে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল উপজেলার ক্ষুদ্র জাতিসত্তার গ্রাম হাকরইলসহ আশপাশের এলাকার মধ্যে সিমতিই প্রথম সাঁওতাল মেয়ে হিসেবে জিপিএ-৫ পেয়েছে। প্রায় ৫০ বছরের পুরোনো নাচোল খুরশেদ মোল্লা সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয় থেকেও ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মেয়ে হিসেবে এই প্রথম কেউ এমন ফল করছে বলে জানান প্রধান শিক্ষক মো. নজরুল ইসলাম।
বিদ্যালয়ের বিজ্ঞান শিক্ষক আমিনুল ইসলাম জানান, দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময়ই সিমতির বাবা মারা গেলে চরম অনটনের মধ্যে পড়ে তার পরিবার। চতুর্থ-পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময় থেকেই জমিতে কাজ করতে থাকে সিমতি।
টেলিভিশন–মুঠোফোন না থাকায় সিমতি মুরমুর কাছে বিনোদন বলতে ছিল কেবল লেখাপড়া। তাঁর স্বপ্ন চিকিৎসক হওয়ার। কেননা সে শুনেছে যে মারা যাওয়ার আগে তার বাবা তেমন চিকিৎসা পাননি। সে বলে, তার মা তো বলেই দিয়েছিলেন যে কলেজে ভর্তি করবেন না। পড়ানোর সামর্থ্য নেই। পরে বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের উদ্যোগে সে উচ্চমাধ্যমিকে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হওয়ার চেষ্টা করছে।
সিমতির মা সাবিনা সরেন বলেন, ‘যখুন না খায়্যাও দিন কাটে, তখুন হামরা কী করে আর বেশি বড় হওয়ার স্বপন দেখতে পারি?’
আমরার স্বপ্ন জনিক বড় অফিসার অইব’
‘বসতবাড়ি ছাড়া আমরার আর কুনু জমিজমা নাই। মোটরসাইকেল চালানোর আয় দিয়াই দুই ছেলের লেহাপড়া ও সংসারের খরচ চালাইতে গিয়া হিমশিম খাইতে অয়। আমরার স্বপ্ন জনিক লেহাপড়া কইরা প্রশাসনের বড় অফিসার অইব। সংসারের যা অবস্থা, তাতে কিবায় যে কিতা করবাম, হেই চিন্তায় কিছুই ভালা লাগে না।’
কথাগুলো বলছিলেন ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেলের চালক মো. আবদুল হাই। তাঁর বাড়ি সুনামগঞ্জের মধ্যনগর উপজেলার বংশীকুন্ডা গ্রামে। তাঁর ছেলে জনিক মিয়া এ বছর বংশীকুন্ডা মমিন উচ্চবিদ্যালয়ের মানবিক বিভাগ থেকে এসএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়েছে। এখন কলেজে ভর্তির খরচ নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছে পরিবারটি।
জনিকের মা গৃহিণী সেলিনা থাতুন বলেন, ‘আমার ছেড়াডার লাইগ্যা কেউ যদি লেহাপড়া খরচের লাইগ্যা আগাইয়া আইতো, তাইলে আমরার খুউব উপকার অইলয়।’ জনিক মিয়া বলে, ‘মা–বাবার দেখা স্বপ্নই আমার স্বপ্ন। আমি লেখাপড়া করে মা–বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে চাই।’
বংশীকুন্ডা মমিন উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. মাহবুবুল আলম বলেন, জনিক মিয়া অত্যন্ত মেধাবী। লেখাপড়া করার সুষ্ঠু পরিবেশ পেলে ভবিষ্যতে সে অনেক দূর এগিয়ে যাবে।
এখন তো খরচ আরও বাড়বে’
অভাবের সংসারে অষ্টম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায়ই প্রাইভেট পড়ানো শুরু করে ঈশিতা খাতুন। সেই আয়ে নিজের পড়ার খরচ নিজেই চালিয়ে নিত। তবে পরীক্ষার আগে যখন প্রাইভেট পড়াতে পারেনি, তখন কৃষিজীবী বাবা তাকে পড়াশোনার খরচ জুগিয়েছেন।
এমন অভাব-অনটনের মধ্যে পড়াশোনা করে জিপিএ–৫ পেয়েছে ফরিদপুর সদরের চর মাধবদীয়া ইউনিয়নের আলিমন্ডলের ডাঙ্গী গ্রামের মেয়ে ঈশিতা। তার লক্ষ্য চিকিৎসক হয়ে মা–বাবার স্বপ্নপূরণ ও মানুষের কল্যাণে কাজ করে যাওয়া।
চর মাধবদিয়া ইউনাইটেড উচ্চবিদ্যালয়ের বিজ্ঞানের ছাত্রী ঈশিতা। তার বাবা সিরাজুল হক কৃষক, মা বেগম আক্তারী গৃহিণী। ঈশিতা জানায়, তার পড়াশোনার ব্যাপারে স্কুলের দুই বিজ্ঞান শিক্ষক অনেক ভূমিকা পালন করেছেন।
ঈশিতার মা বেগম আক্তারী জানান, ‘খেয়ে না খেয়ে মেয়েকে পড়িয়েছি। এখন তো খরচ আরও বাড়বে। খরচের এ টাকা কীভাবে জোগাড় করব, সে কথা ভেবে রাতে ঘুম আসে না।’ ঈশিতার বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবুল কালাম আজাদ বলেন, ঈশিতার সামনে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। তবে আর্থিকভাবে তার পরিবার খুবই অসচ্ছল।
বাল্যবিবাহ ঠেকানো বর্ষা জিপিএ-৫ পেয়েছে
মায়ের কোলে ১৪ দিনের নবজাতক বর্ষা রানী। ওই সময়ই ঘটে মা–বাবার বিচ্ছেদ। মা–বাবা নতুন সংসার শুরু করলে মামার বাড়িতেই বেড়ে ওঠে বর্ষা। অসচ্ছল সংসার, তবু মামার পরিবারে থেকে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে থাকে বর্ষা।
নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় বর্ষার বিয়ের প্রস্তাব এসেছিল। কিন্তু সে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে চায়। এমন প্রতিকূলতার ভেতর দিয়েই এ বছর এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ–৫ পেয়েছে বর্ষা রানী। সে লালমনিরহাটের আদিতমারীর ভেলাবাড়ি স্কুল অ্যান্ড কলেজের বিজ্ঞানের ছাত্রী ছিল।
বর্ষার মামার বাড়ি লালমনিরহাটের আদিতমারীর ভেলাবাড়ির শালমারা গ্রামে। তার মামা বাবুল চন্দ্র রায় হাজীগঞ্জ বাজারের একটি ওয়ার্কশপে শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। তিনি বলেন, ‘বর্ষা ভবিষ্যতে চিকিৎসক হয়ে আর্তমানবতার সেবা করতে চায়। তবে ভালো কলেজে ভর্তি করে পড়ানোর সামর্থ্য আমার নেই।’
বর্ষা রানী বলে, অষ্টম শ্রেণি থেকে এসএসসি পর্যন্ত বিদ্যালয়ে যাতায়াত করেছে প্রায় দুই কিলোমিটার পথ হেঁটে। অনেক দিন খালি পেটে পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে। পড়াশোনার খরচ চালাতে নবম–দশম শ্রেণিতে গ্রামের ছোট শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট টিউশন পড়িয়েছে সে।
বর্ষার স্কুলের প্রধান শিক্ষক রোকছানা খাতুন বলেন, ‘প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বর্ষা রানী জিপিএ–৫ পেয়েছে। আমরা আশাবাদী, সুযোগ পেলে সে তার স্বপ্ন পূরণ করতে পারবে।’