ফেনী প্রতিনিধি
টানা বর্ষণ এবং উজান থেকে নেমে আসা ভারতীয় ঢলের কারণে ফেনীর জনজীবনে ফের নেমে এসেছে ভয়াবহ দুর্যোগ। মুহুরী ও সিলোনিয়া নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের অন্তত দশটি স্থান ভেঙে যাওয়ায় ফুলগাজী ও পরশুরাম উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। মঙ্গলবার (৮ই জুলাই) বিকেল থেকেই লোকালয়ে হু হু করে পানি প্রবেশ করতে শুরু করেছে, যা গত বছরের ভয়াবহ বন্যার দুঃস্বপ্ন ফিরিয়ে এনেছে।
শহরের চিত্র: জলমগ্ন রাজপথ, থমকে জনজীবন
অবিরাম বৃষ্টিতে ফেনী শহরের ডাক্তারপাড়া, শহীদ শহিদুল্লা কায়সার সড়ক, পুরাতন রেজিস্ট্রি অফিস, শাহীন একাডেমি এলাকা, পাঠানবাড়ি, নাজির রোড, মিজান রোড, একাডেমি, সদর হাসপাতাল মোড় ও পেট্রোবাংলাসহ বিভিন্ন এলাকায় ভয়াবহ জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। নিচু সড়কগুলো পুরোপুরি পানির নিচে তলিয়ে গেছে, দোকানপাটে পানি ঢুকে মালপত্রের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। যদিও বিকেল থেকে পানি কিছুটা ধীরগতিতে নামতে শুরু করেছে, তবুও ক্ষতির পরিমাণ বিশাল।
নদীর বাঁধ: ১০ স্থানে ভাঙন, ১৫ গ্রাম প্লাবিত
ফেনী পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, মুহুরী নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের পরশুরাম উপজেলার চিথলিয়া ইউনিয়নের মধ্যম ধনীকুন্ডা, নোয়াপুর, শালধর এলাকায় তিনটি, এবং ফুলগাজী উপজেলার দেড়পাড়ায় দুইটি, নাপিত কোনায় একটি স্থানে বড় ধরনের ভাঙন দেখা দিয়েছে। এছাড়া সিলোনিয়া নদীর মির্জানগর ইউনিয়নের পশ্চিম গদানগর, জঙ্গলঘোনা, উত্তর মনিপুর দাসপাড়া ও মেলাঘর কবরস্থানের পাশে চারটি স্থানে ভাঙন সৃষ্টি হয়েছে। এর ফলে অন্তত ১৫টি গ্রামের হাজারো মানুষ পানিবন্দী হয়ে চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন।
ফেনী পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী আবুল কাশেম জানান, প্রাথমিকভাবে পাঁচটি স্থানে ভাঙনের খবর পাওয়া গেলেও, এখন পর্যন্ত মোট দশটি স্থানে ভাঙনের তথ্য নিশ্চিত করা হয়েছে। মাঠপর্যায়ে তাদের কাজ অব্যাহত আছে এবং পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।
বৃষ্টিপাতের রেকর্ড: সর্বোচ্চ ৪৪০ মিলিমিটার!
ফেনী আবহাওয়া অফিসের ইনচার্জ মো. মজিবুর রহমান জানিয়েছেন, গত দুই দিন ধরে জেলায় মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টিপাত হচ্ছে। মঙ্গলবার (৮ই জুলাই) সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৪৪০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে, যা বিগত কয়েক বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। তিনি আরও জানান, আগামী ২-৩ দিন জেলাজুড়ে বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকার সম্ভাবনা রয়েছে, যা পরিস্থিতিকে আরও অবনতির দিকে নিয়ে যেতে পারে।
উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী আবুল কাশেম আরও জানান, দুপুরে মুহুরী ও সিলোনিয়া নদীর পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করেছে। উজানে বৃষ্টি অব্যাহত থাকলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধগুলোর বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড সতর্ক অবস্থানে রয়েছে।
প্রশাসনের প্রস্তুতি: কঠোর নজরদারি ও ত্রাণ তৎপরতা
ফেনী জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম গতকাল সন্ধ্যায় ফুলগাজীর নদীভাঙন এলাকা পরিদর্শন করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনিয়া নদীতে পানি বৃদ্ধির বিষয়টি জেলা প্রশাসন নিয়মিত তদারক করছে এবং বন্যার সব প্রস্তুতি ইতোমধ্যে গ্রহণ করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, গত বছরের আগস্টে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় ফেনীর সব উপজেলায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল, ২৯ জনের প্রাণহানি এবং ১০ লাখের বেশি মানুষ পানিবন্দী হয়েছিলেন। জেলা প্রশাসন থেকে জানানো হয়েছিল, ২০২৪ সালের বন্যায় প্রায় ২ হাজার ৬৮৬ কোটি ২০ লাখ ৫০০ টাকার ক্ষতি হয়েছিল। এবারও কি সেই ভয়াবহতার পুনরাবৃত্তি হতে চলেছে? প্রশ্ন এখন ফেনীবাসীর মনে।