অন্যান্য

বরগুনায় এডিসের লার্ভার ঘনত্ব স্বাভাবিকের চেয়ে ৮ গুণ বেশি

  প্রতিনিধি 26 June 2025 , 7:49:50 প্রিন্ট সংস্করণ

মোঃ শাহজালাল, বরগুনা 

বরগুনায় সুপেয় পানির সংকট মেটাতে মানুষের ঘরে ঘরে জমানো পানিই এখন হয়ে উঠেছে প্রাণঘাতী এডিস মশার প্রজননক্ষেত্র। ড্রাম, বালতি, ট্যাংক যেখানেই পানি জমে আছে, সেখানেই প্রজনন বিস্তার করছে এডিস। সর্বশেষ বুধবার সরকারের রোগতত্ত¡, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) ‘ডেঙ্গু আউট ব্রেক ইনভেস্টিগেশন ইন বরগুনা’ শীর্ষক জরিপে জেলার সদর উপজেলায় এডিস মশার ঘনত্ব স্বাভাবিকের চেয়ে ৮ গুণ বেশি দেখা যায়।
বরগুনা পৌরসভার ৩১ শতাংশ ও জেলার সদর উপজেলার ৭৬ শতাংশ বাড়িতেই ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে। এর মধ্যে পৌরসভায় গড় লার্ভা ব্রæটো ইনডেক্স ৪৭ ও সদর উপজেলায় ১৬৩।
বরগুনা পৌরসভার নয়টি ওয়ার্ডের মধ্যে পাঁচটি ওয়ার্ডই ডেঙ্গুর উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। এসব ওয়ার্ডে গড় ব্রæটো ইনডেক্স ৪০-১৫৩। বিশেষ করে জেলা সদরে লার্ভার ঘনত্ব স্বাভাবিকের তুলনায় সাড়ে ৮ গুণ বেশি।
বরগুনা জেলায় ডেঙ্গুর ডেন-৩ ও ডেন-২ সেরোটাইপের প্রাদুর্ভাব বাড়ছে। মোট ডেঙ্গু রোগীর ৪৭ শতাংশ ডেন-৩, ৪০ শতাংশই ডেন-২ এবং ১৪ শতাংশ ডেন-২ ও ডেন-৩ সেরোটাইপ দ্বারা আক্রান্ত।
কোনো কোন এলাকায় এডিস মশার লার্ভার উপস্থিতি হিসাব করা হয় ব্রæটো ইনডেক্সের মাধ্যমে। এই ইনডেক্স ২০ এর বেশি হলেই তাকে ঝুঁকিপূর্ণ বলা হয়।
সরকারের রোগতত্ত¡, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) ‘ডেঙ্গু আউট ব্রেক ইনভেস্টিগেশন ইন বরগুনা’ শীর্ষক এক জরিপে এই তথ্য উঠে এসেছে। বুধবার আইইডিসিআরে জরিপের ফল প্রকাশ করা হয়।
জরিপের ফল উপস্থাপনকালে আইইডিসিআর পরিচালক অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরিন জানান, ৪৩টি নমুনার জিনোম পরীক্ষা করে দেখা গেছে এই জেলায় ডেন-৩ ও ডেন-২ ধরনের ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি। ১৬ থেকে ২২ জুন এই জরিপ পরিচালনা করা হয়। ভর্তি রোগীদের মধ্যে বরগুনা সদরে ডেঙ্গু আক্রান্ত বেশি, এরপর পাথরঘাটায়। কম রোগী ছিল আমতলী আর বেতাগী উপজেলায়।
তবে বরগুনায় ডেঙ্গুর চিত্র কতটা ভয়াবহ তা এখনই বলা যাচ্ছে না বলে জানান ডা. তাহমিনা শিরিন। তিনি বলেন, এটি বুঝতে আরও সময় লাগবে। তবে এখানকার ঘরে ঘরে সচেতনতা বাড়াতে হবে। পানির পাত্র ঢেকে রাখতে হবে। নিজেদের সচেতন হতে হবে।
লার্ভার ঘনত্ব বেশি সদর উপজেলায় : জরিপের তথ্য অনুযায়ী, বরগুনা পৌরসভার ১৩৮টি বাড়ির মধ্যে ৪৩টি বাড়িতে, অর্থাৎ ৩১ শতাংশ এবং সদর উপজেলার ৪৬টি বাড়ির মধ্যে ৭৬ শতাংশ বাড়িতে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে। তবে পৌরসভার তুলনায় সদর উপজেলায় লার্ভার ঘনত্ব সাড়ে তিন গুণ ও স্বাভাবিকের তুলনায় আটগুণ বেশি। সদর উপজেলায় গড় লার্ভা ব্রæটো ইনডেক্স ১৬৩ ও পৌরসভায় ব্রæটো ইনডেক্স ৪৭।
বেশি ঝুঁকিতে ৫ ওয়ার্ড : জরিপে দেখা গেছে, বরগুনা পৌরসভার নয়টি ওয়ার্ডের মধ্যে পাঁচটি ওয়ার্ডে ব্রæটো ইনডেক্স ২০ এর বেশি ও আটটি বাড়িতে ব্রæটো ইনডেক্স ১০এর বেশি। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে পাঁচটি ওয়ার্ড। ৭ নম্বর ওয়ার্ডে ব্রæটো ইনডেক্স ১৫৩, ৯ নম্বর ওয়ার্ডে ব্রæটো ইনডেক্স ১৩৩, ২ নম্বর ওয়ার্ডে ব্রæটো ইনডেক্স ৪০, ৮ নম্বর ওয়ার্ডে ব্রæটো ইনডেক্স ৩৩ ও ৬ নম্বর ওয়ার্ডে ব্রæটো ইনডেক্স ৩১।
বাকি চারটি ওয়ার্ডের মধ্যে ৪ নম্বর ওয়ার্ডে কোনো লার্ভা মেলেনি। বাকি তিনটির মধ্যে ১ নম্বর ওয়ার্ডে ব্রæটো ইনডেক্স ছিল ১৩ এবং ৩ ও ৫ নম্বর ওয়ার্ডে ব্রæটো ইনডেক্স ১২ দশমিক ৫০ করে ছিল।
৫৬% স্বতন্ত্র বাড়ি ও ৩৮% প্লাস্টিক ড্রামে লার্ভা : জরিপে বরগুনার ৫৬ শতাংশ স্বতন্ত্র বাড়ি, ৩৩ শতাংশ সেমি পাকা বাড়ি, ৯ শতাংশ বহুতল ভবন ও ২ শতাংশ নির্মাণাধীন ভবনে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে।
অন্যদিকে, ৩৮ শতাংশ প্লাস্টিকের ড্রাম, ২৮ শতাংশ প্লাস্টিকের বালতি, অন্যান্য স্থানে ১৯ শতাংশ, ৬ শতাংশ সিমেন্টের পাত্র, ৫ শতাংশ ফুলের টব ও ফুলদানি, ৩ শতাংশ প্লাস্টিকের মগ ও বদনা, ২ শতাংশ প্লাস্টিক বোতলে এডিস মশার প্রজনন স্থান হিসেবে পাওয়া গেছে।
৫৮% এলবোপিক্টাস মশা, ডেন-৩ ৪৭% : জরিপের তথ্য অনুযায়ী, বরগুনায় দুই ধরনের এডিস মশার মধ্যে এডিস এলবোপিক্টাস পাওয়া গেছে ৫৮ শতাংশ ও এডিস এজিপ্টি ৪২ শতাংশ।
অন্যদিকে, বরগুনায় ডেন-৩ ধরনের ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি। এখানকার মোট রোগীর ৪৭ শতাংশই এই ধরন দ্বারা আক্রান্ত। এরপর ডেন-২ দ্বারা আক্রান্ত ৪০ শতাংশ এবং ডেন-২ ও ডেন-৩ উভয় ধরনের ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ১৪ শতাংশ রোগী।
চিকিৎসকরা বলেন, ২০২৪ সালে রাজধানীতে ডেঙ্গু রোগীদের ৮৫ শতাংশেরও বেশি ডেন-২ দ্বারা আক্রান্ত ছিলেন। ২০২৩ সালেও ডেন-২ আক্রান্তের সংখ্যা ছিল বেশি। সে বছর সীমিতসংখ্যক নমুনা বিশ্লেষণে ৬২ শতাংশ রোগীর ডেন-২ ধরন দেখা যায়। বাকি ৩৮ শতাংশ আক্রান্ত ছিলেন ডেন-৩ দ্বারা। আর ২০২২ সালে প্রাধান্য ছিল ডেন-৩ ধরনের। সে বছর ৯০ শতাংশ রোগী আক্রান্ত হয়েছিল এই ধরন দ্বারা। বাকি প্রায় ১০ শতাংশ ছিল ডেন-৪ দ্বারা আক্রান্ত। এ বছর আবার ডেন-৩ এর প্রাধান্য দেখা দিচ্ছে।
মোট রোগীর ২৭% বরগুনায় : স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত দেশের সর্বোচ্চ রোগীর বরগুনা জেলায়, যা বছরের মোট রোগীর ২৭ শতাংশ। এই জেলায় মারা গেছে ছয়জন, যা মোট মৃত্যুর ১৭ শতাংশ।
বরগুনা জেলায় ২৫ দিনে বছরের সর্বোচ্চ ১ হাজার ৩০৯ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছে। এরপর মে মাসে ৬৬৪ জন, এপ্রিল মাসে ১৬৫ জন, জানুয়ারি মাসে ৩৮ জন, ফেব্রুয়ারী মাসে ১৪ জন ও মার্চ মাসে ১২ জন রোগী ভর্তি হয়েছে।

আরও খবর

                   

জনপ্রিয় সংবাদ