অন্যান্য

বাংলাদেশের আইনে কী আছে পুরুষদের ধর্ষণের বিষয়ে?

  প্রতিনিধি 18 March 2025 , 9:51:21 প্রিন্ট সংস্করণ

তানহা তাসনিম

বাংলাদেশে পুরুষেরা ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতনের শিকার হলে তা অনেক ক্ষেত্রেই উপেক্ষিত থেকে যায়। ভুক্তভোগীদের আইনের আশ্রয় নেওয়ার প্রবণতা কম। কারণ বিদ্যমান সংশ্লিষ্ট আইনে কোনো পুরুষ যদি ধর্ষণের শিকার হন, তার জন্য আইনে কোনো বিধান নেই। বিচার চাইতে হয় ভিন্ন আইনে।

ঢাকার কাছে নারায়ণগঞ্জে গত আটই মার্চ ২০ বছর বয়সী এক তরুণ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ ওঠে। ঘটনার তিন দিন পর ১১ই মার্চ মামলা নথিভুক্ত করা হয় বলে জানিয়েছেন নারায়ণগঞ্জের বন্দর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ তরিকুল ইসলাম।

মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, ঘটনার দিন ভুক্তভোগীর এক প্রতিবেশী তাকে নিজ ঘরে ডেকে নিয়ে জোরপূর্বক যৌন সম্পর্ক করে।

ফৌজদারি দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারায় ‘বলাৎকার’ হিসেবে মামলাটি রুজু করা হয়েছে। কারণ ১৬ বছর বয়সের উপরে ধর্ষণের শিকার ছেলেদের জন্য বাংলাদেশে আলাদা কোনো আইন নেই।

অথচ মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যান বলছে, গত দুই বছরে শূন্য থেকে ১৮ বছর বয়সী ১১১ জন ছেলে ধর্ষণের শিকার হয়েছে, যার মধ্যে মামলা করা হয়েছে কেবল ৫৫টি।

বিশ্লেষকরা বলছেন, পুরুষ নির্যাতনের বিষয়ে সচেতনতা না থাকার কারণেই এখনও পুরনো আইন দিয়েই এ সম্পর্কিত অভিযোগের বিচার কাজগুলো হচ্ছে। এতে করে ভুক্তভোগীদের

পরিসংখ্যানে ধর্ষণ যৌন নির্যাতনের শিকার পুরুষ

বাংলাদেশে ধর্ষণের ঘটনা নিয়ে যে রকম আলোচনা দেখা যায়, তাতে অনেকাংশেই উপেক্ষিত থাকে পুরুষদের যৌন নির্যাতন বা ধর্ষণের ঘটনাগুলো।

ফলে নারী শিশু নির্যাতনের ঘটনার নানা তথ্যউপাত্ত পাওয়া গেলেও, পুরুষদের ক্ষেত্রে খুব কম সময়ই তা পাওয়া যায়।

১৮ বছর পর্যন্ত ধর্ষণ, ধর্ষণের চেষ্টা যৌন নির্যাতনের শিকার ছেলেদের বিষয়ে তথ্য দিয়েছে মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা সংস্থা আইন সালিশ কেন্দ্র।

এতে দেখা গেছে, ২০১৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে ২২৬ জন যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে, যার মধ্যে মামলা করা হয়েছে ১৪৬টি।

আর ২০২০ থেকে ২০২৪ সাল এই পাঁচ বছরে ২৪ জন ধর্ষণচেষ্টার শিকার হয়েছে। এসময়ে মামলা হয়েছে ১৪টি।

আর ২০২৩ সালে ৭৫ জন এবং ২০২৪ সালে ৩৬ জন ছেলে শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে।

কেবল বাংলাদেশেই না, বিশ্বব্যাপী পুরুষদের ধর্ষণের চিত্র অনেকটা একই।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অলাভজনক প্রতিষ্ঠান আরএআইএনএন’র তথ্যমতে দেশটিতে ধর্ষণের শিকার প্রতি ১০ জনে একজন পুরুষ।

দেশটির ২৪ দশমিক ৮ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় এক চতুর্থাংশ পুরুষ যৌন সহিংসতার শিকার হয়েছেন বলে জানাচ্ছে যৌন নির্যাতন রোধে যুক্তরাষ্ট্রের আরেকটি সংস্থা ন্যাশনাল সে আর ধর্ষণ বা ধর্ষণচেষ্টার শিকার প্রতি চারজন পুরুষের একজন ১১ থেকে ১৭ বছর বয়সের মধ্যে প্রথমবার এমন অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে গেছে।

বাংলাদেশের আইনে যা বলা আছে

বাংলাদেশের আইনে ধর্ষণের সংজ্ঞায়ন করা হয়েছে ফৌজদারি দণ্ডবিধির ৩৭৫ ধারায়। এই আইন অনুযায়ী, কেবল পুরুষের দ্বারা কেবল একজন নারীই ধর্ষণের শিকার হতে পারে।

কোনো ছেলে যদি ধর্ষণের শিকার হন, তার জন্য আইনে কোনো প্রভিশনই (বিধান) নেই। কেননা ছেলেদের ধর্ষণের বিষয়টা আইনে কখনো চিন্তাই করা হয়নি“, বলেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইশরাত হাসান।

নারী শিশু নির্যাতন দমনে ২০০০ সালে একটি আইন প্রণয়ন করা হয়। এই আইনে শুরুতে কেবল নারী ১৬ বছর বয়সের কম বয়সী মেয়ে শিশুদের কথা বলা হলেও হাইকোর্টের এক আদেশের পর ছেলে শিশুদেরও এতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

অর্থাৎ, ১৬ বছরের বেশি বয়সী কোনো ছেলে ধর্ষণের শিকার হলেও প্রচলিত আইনে তা বিচারের কোনো সুযোগ নেই।

সেক্ষেত্রে দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারা অনুযায়ী মামলা রুজু করতে হয়, যেমনটা দেখা গেছে নারায়ণগঞ্জের ঘটনায়।

আইনের এই ধারায় আনন্যাচারাল অফেন্স বা প্রকৃতিবিরুদ্ধ অপরাধের বিষয়ে উল্লেখ করা হয়েছে।

অর্থাৎ কেউ যদি স্বেচ্ছায় কোনো পুরুষ, নারী বা পশু প্রকৃতির নিয়মের বিরুদ্ধে যৌন সঙ্গম করে তবে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হবে।

পেনাল কোডের আইনের সংজ্ঞা অনুযায়ী ধর্ষণ হয় না, এটা হলো প্রথম সমস্যা“, বলেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী তারিক রিজভী।

দ্বিতীয়ত, নারী শিশু নির্যাতন দমন আইনেও পূর্ণবয়স্ক পুরুষদের জন্যে কোনো ধারা না থাকায়, সেই অনুযায়ীও আইনি ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব নয়।

তবে ধর্ষণের অভিযোগের ক্ষেত্রে নারীপুরুষে কোনো বিভেদ হওয়া উচিৎ না বলেই মনে করেন বেসরকারি সংস্থা আইন সালিশ কেন্দ্রের চেয়ারপার্সন এবং সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী জহিরুল ইসলাম খান পান্না।

ছেলেদের সাথেওতো এটি জোরপূর্বক ঘটানো হচ্ছে। ফলে এক্ষেত্রেও সমান শাস্তিই হওয়া উচিৎ“, বলেন তিনি।

আরেক আইনজীবী ইশরাত হাসান মনে করেন, “তৃতীয় লিঙ্গের কেউ ধর্ষণের শিকার হলে, তারজন্যেও আলাদা কোনো আইন নেই। কিন্তু তাদেরতো বিচার পাওয়ার অধিকার আছে।

প্রয়োজন আইনের যৌক্তিক সংস্কার

ছেলেরা ধর্ষণের শিকার হলে বর্তমানে ৩৭৭ ধারায় মামলা করা হলেওএই বিষয়গুলো স্পষ্টভাবে আইনে আসা প্রয়োজনবলেই মত সংশ্লিষ্টদের।

এনিয়ে আইনজীবী ইশরাত হাসান বলেন, “আইনের যৌক্তিক সংস্কার প্রয়োজন

আগে পেনাল কোডের মাধ্যমেই ধর্ষণের সাজা হতো। পরে বিশেষ আইন হিসেবে নারী নির্যাতন দমন আইন আসলো। কিন্তু এখনও অনেক বিষয়ই আগের আইনে বিচার হয়ে আসছে, এতে পরিবর্তন আসা প্রয়োজন

যেমন নারী নির্যাতন দমন আইনে মামলা করলে, ওই আইন অনুযায়ী মেডিক্যাল টেস্ট, ডিএনএ টেস্টের বিধান আছে। কিন্তু পেনাল কোডে এই বিধানগুলো নেই, বলেন তিনি।

বিশেষ করে ধর্ষণের মতো ঘটনাকে ছোটো করে দেখার সুযোগ নেই বলেও মত সংশ্লিষ্টদের, তা নারীর ক্ষেত্রে হোক কিংবা পুরুষের ক্ষেত্রে হোক।

আর ৩৭৭ ধারায় মামলা করার কারণে শাস্তির বিধানেও আসে তারতম্য। যেমনবাংলাদেশ ফৌজদারি দণ্ডবিধির ৩৭৫ ধারায় কারও অপরাধ প্রমাণিত হলে, সর্বোচ্চ শাস্তি হতে পারে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড কিংবা মৃত্যুদণ্ড।

কিন্তু ৩৭৫ ধারায় কোনো অপরাধ প্রমাণিত হলে, অপরাধীর শাস্তি হবে ১০ বছর থেকে শুরু করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।

এই আইনজীবীর মতে, ধর্ষণের জন্য আলাদা ট্রাইব্যুনাল থাকা দরকার। কারণএটা অন্য অপরাধের সঙ্গে মেলে না

তিনি বলেন, “ল্যাব থেকে যদি রিপোর্ট আসতেই চারপাঁচ মাস চলে যায়, আইনে যতই ৯০ দিনে বিচারের কথা থাকুক, সেটা করা সম্ভব হবে না।

রিপোর্ট পাওয়ার আগে, বিচারক বিচার করবে কীভাবে?” প্রশ্ন তোলেন তিনি।

ধর্ষণের দ্রুত বিচার পেতে ট্রাইব্যুনাল এবং ট্রাইব্যুনালের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোর দিকে নজর দেয়ার কথা বলেন এই আইনজীবী।

দ্রুতটার সাথে টেস্টের রিপোর্টগুলো পেতেপ্রত্যেক জেলায় না হলেও অন্তত প্রত্যেক বিভাগে মেডিক্যাল টেস্ট ডিএনএ টেস্টের ল্যাব থাকা প্রয়োজনবলেও মন্তব্য করেন মিজ হাসান। সুত্রঃ বিবিসি বাংলা 

Author

আরও খবর

                   

জনপ্রিয় সংবাদ