অন্যান্য

বাংলা ব্লকেডে উত্তাল দেশ: কোটা সংস্কার দাবিতে সর্বাত্মক অবরোধে অচল ঢাকা, নিহত ২

  প্রতিনিধি 8 July 2025 , 3:20:30 প্রিন্ট সংস্করণ

মাহতিম আহমেদ ঢাকা।

সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা বাতিলের এক দফা দাবিতে গতকাল সোমবার (৭ জুলাই) ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর ডাকে দেশজুড়ে পালিত হলো এক নজিরবিহীন ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের হাজার হাজার শিক্ষার্থী সড়ক ও রেলপথ অবরোধ করে রাজপথ কাঁপিয়েছেন। এই সর্বাত্মক অবরোধে কার্যত অচল হয়ে পড়েছিল ঢাকা, আর সেদিন নবীগঞ্জে এক ভয়াবহ সংঘর্ষে ১৪৪ ধারা ভেঙে প্রাণ হারান দুজন, আহত হন শতাধিক।
রাজধানীজুড়ে অচল অবস্থা
গতকাল সকাল থেকেই রাজধানী ঢাকার শাহবাগ মোড়, সায়েন্স ল্যাব, নিউমার্কেট, নীলক্ষেত, চানখাঁরপুল, আগারগাঁও, কারওয়ান বাজারসহ ১১টি গুরুত্বপূর্ণ মোড় এবং একটি রেলপথ শিক্ষার্থীদের দখলে চলে যায়। ‘কোটা না মেধা, মেধা মেধা’ এবং ‘একাত্তরের হাতিয়ার, গর্জে উঠুক আরেকবার’ স্লোগানে মুখরিত ছিল রাজপথ। বিকাল ৪টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা শাহবাগ মোড় অবরোধ করে রাখলে পুরো রাজধানীজুড়ে দেখা দেয় তীব্র যানজট। এমনকি ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের সামনে বিদেশি অতিথিবাহী মাইক্রোবাস আটকে দেওয়ার ঘটনাও ঘটে। শিক্ষার্থীদের এই স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রায় পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়।
দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়া আন্দোলন
শুধু ঢাকা নয়, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, ময়মনসিংহ, সাভার, গোপালগঞ্জ, বরিশাল, কুষ্টিয়া, রংপুর এবং কুমিল্লার মতো দেশের অন্তত ৯টি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও একযোগে রেলপথ ও মহাসড়ক অবরোধ করে আন্দোলনে অংশ নেন। এটি ছিল এক সর্বাত্মক ব্লকেডের প্রচেষ্টা, যা আগের দিনের কর্মসূচির ধারাবাহিকতা।
এক দফা দাবির দৃঢ়তা
আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম শাহবাগ মোড়ে অবরোধ তুলে নেওয়ার আগে জানান, তাদের অর্ধবেলা নয়, একটি সর্বাত্মক ব্লকেডের পরিকল্পনা ছিল। তিনি স্পষ্ট করে বলেন, চার দফা দাবির পরিবর্তে তাদের একমাত্র দাবি হলো – সরকারি চাকরিতে সব গ্রেডের কোটা বাতিল করা এবং কেবল সংবিধান অনুযায়ী অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য ন্যূনতম কোটা রেখে সংসদে আইন পাস করা। নাহিদ দৃঢ়ভাবে জানান, সরকারই এই বিষয়টি সমাধান করতে পারে, আদালতের মাধ্যমে এর সমাধান সম্ভব নয়। তারা ৬৫ সদস্যের একটি সমন্বয়ক দল গঠন করেছেন এবং দীর্ঘমেয়াদি আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে শিক্ষার্থীদের হয়রানির বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দেন তারা।
সরকারের অবস্থান ও রাজনৈতিক পটভূমি
আন্দোলন চলাকালীন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবনে যুব মহিলা লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে বলেন, কোটার বিষয়টি এখন আদালতে বিচারাধীন এবং আদালতের রায় উপেক্ষা করে আন্দোলন চালানো সঠিক নয়। তিনি প্রশ্ন তোলেন, যারা কোটা আন্দোলন করছেন, তাদের মধ্যে কতজন পিএসসি পরীক্ষায় বসেছেন এবং উত্তীর্ণ হয়েছেন? তিনি আরও উল্লেখ করেন, কোটা থাকার কারণে আগে মেয়েরা ও পিছিয়ে পড়া জেলা-গোষ্ঠী সুযোগ পেত, এখন তারা সেই সুযোগ হারাচ্ছে। হাইকোর্টের রায় মেনেই চলা সরকারের অবস্থান, এবং আন্দোলনের নামে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা থেকে দূরে রাখা যুক্তিযুক্ত নয় বলে তিনি মনে করেন।
ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় আন্দোলনকারীদের সংকল্প
এই দিনের ঘটনাপ্রবাহে স্পষ্ট হয় যে আন্দোলন বিস্তৃত, সাংগঠনিক এবং দাবি সুসংহত হলেও রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র, মিডিয়া বিভ্রান্তি এবং সরকারের চাপের মুখে আন্দোলনকারীরা এক কঠিন পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন। তবে, ১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় ‘আমি কে, তুমি কে- রাজাকার রাজাকার’ স্লোগান সংবলিত একটি ব্যানার আসার পর আন্দোলনকারীরা দ্রুত ও দৃঢ় প্রতিক্রিয়া জানান। তারা পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দেন যে এই আন্দোলন কোনো রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় নয়, বরং এটি একটি স্বাধীন, স্বতঃস্ফূর্ত ও ছাত্র-জনতার যৌক্তিক দাবির সংগ্রাম। এই স্পষ্ট অবস্থান প্রমাণ করে, তারা বিভ্রান্তি ও ষড়যন্ত্রের ঊর্ধ্বে থেকে একটি ন্যায়সংগত, গণতান্ত্রিক ও গণমানুষের আন্দোলন গড়ে তুলতে সংকল্পবদ্ধ।
সার্বিকভাবে ৮ জুলাইয়ের এই ঘটনা দেশব্যাপী কোটা সংস্কার ও সরকারি চাকরিতে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে ইতিহাসে লিপিবদ্ধ হয়ে থাকবে।

আরও খবর

                   

জনপ্রিয় সংবাদ