অন্যান্য

বিরল প্রেমের পাখি ‘ধনেশ’: প্রকৃতিতে আত্মত্যাগ ও মাতৃত্বের অনন্য প্রতীক, তবুও বিলুপ্তির পথে !

  প্রতিনিধি 25 July 2025 , 1:05:02 প্রিন্ট সংস্করণ

মাহতিম আহমেদ রাজা: ঢাকা, ২৫ জুলাই ২০২৫: প্রকৃতির বুকে এক অসাধারণ প্রেমের গল্প বুনে চলে ধনেশ পাখি, যার প্রণয়কাব্য যেন জীবনানন্দ দাশের কবিতার পাতা থেকে উঠে আসা। প্রজনন মৌসুমে স্ত্রী ধনেশ গাছের ফোকরে নিজেকে আবদ্ধ করে ডিম পাড়ে, আর পুরুষ ধনেশ কাদা ও ফলের মাংসল অংশ দিয়ে কোটরের মুখ প্রায় বন্ধ করে দেয়। এরপর ছয় থেকে আট সপ্তাহ ধরে এই অতন্দ্র প্রহরী বাইরে থেকে স্ত্রী ও শাবকদের জন্য খাবার সংগ্রহ করে। বাচ্চা উড়তে শেখা পর্যন্ত তাদের খাদক প্রজাতি থেকে রক্ষা করে এবং পুরুষ পাখি কখনো সঙ্গী বদলায় না। ধনেশের এই ভালোবাসা ‘মানবপ্রেমের চেয়েও গভীর’ এবং স্ত্রী ধনেশের মাতৃত্ব ও আত্মত্যাগ পাখিজগতে বিরল।

অস্তিত্ব সংকটে ‘বনের মালি’

অমর প্রেমের এই পাখি অনেক অঞ্চলে ‘ধনপাখি’, ‘ডুমুরখেকো’ বা ‘বড় ঠোঁটওয়ালা পাখি’ নামে পরিচিত। একসময় চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, সিলেট ও সুন্দরবনের কিছু এলাকায় এদের অবাধ বিচরণ দেখা গেলেও, পরিবেশগত বিপর্যয়, বন উজাড় এবং নির্বিচার শিকারের কারণে ধনেশ এখন প্রায় বিলুপ্তপ্রায়। বর্তমানে সীমিত সংখ্যায় এদের বান্দরবান ও রাঙ্গামাটির গহিন অরণ্যে টিকে থাকতে দেখা যায়।

ধনেশ শুধু বনের প্রাণীই নয়, অরণ্যের প্রাণচক্র বা বাস্তুসংস্থানেরও অতি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এরা ফল খেয়ে বীজ ছড়িয়ে দেয় পুরো বন জুড়ে, বিশেষ করে ডুমুর গাছের বীজ বিস্তারে ধনেশের ভূমিকা অপরিসীম। এ কারণেই পাখিটিকে ‘ফরেস্ট গার্ডেনার’ বা ‘বনের মালি’ হিসেবে ডাকা হয়।

বিবর্তন ও অনন্য বৈশিষ্ট্য

বিজ্ঞানীদের মতে, ধনেশ পাখির আদিপুরুষের উদ্ভব ঘটেছিল প্রায় ৩-৪ কোটি বছর আগে আফ্রিকা ও এশিয়ায়। প্রথম দিকে ছোট ও সরল ঠোঁট থাকলেও পরে ঠোঁট বড় ও ক্যাস্ক (ফাঁপা অংশ) বিবর্তিত হয়। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, সঙ্গী আকর্ষণে এবং গাছের ভেতরে থাকা ফল সহজে সংগ্রহ করতে বড় ঠোঁট তৈরি হয়েছে। বিবর্তিত ফাঁপা অংশের কারণে ধনেশ পাখিরা উচ্চশব্দ সৃষ্টি করতে পারে, যা প্রতিপক্ষকে ভয় পাওয়ায়। প্রাণিকুলে ধনেশ পাখির বিবর্তনকে বিশেষজ্ঞরা ‘বিস্ময়কর’ বলে আখ্যায়িত করেছেন।

ধনেশ বিশ্বের একমাত্র পাখি, যার প্রথম দুটি ঘাড়ের হাড় (কশেরুকা) এক্সিস ও এটলাস একে-অন্যের সঙ্গে মিশে আছে, যার মাধ্যমে এরা লম্বা ঠোঁটকে ধারণ ও বেশি স্থিতিশীল রাখতে পারে। এদের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য হলো লম্বা, নিম্নমুখী বাঁকানো উজ্জ্বল বর্ণের ঠোঁট। ধনেশের প্রধান আকর্ষণ হলো ঘাড়ের মাংসপেশির সহায়তায় মেরুদণ্ডের সঙ্গে যুক্ত শক্তিশালী ও ভারী ঠোঁট, যা দিয়ে এরা বিপদ মোকাবিলা, আহার সংস্থান, বাসা তৈরি ও শিকার করে থাকে। এরা জোড়ায় জোড়ায় থাকতে ভালোবাসে এবং সর্বভুক হিসেবে পরিচিত।

লোকসংস্কৃতিতে ধনেশ ও বিলুপ্তির হুমকি

বিরল প্রেমের পাখি ধনেশকে নিয়ে বিভিন্ন দেশের লোকসংস্কৃতিতে নানা মিথ বা গল্প প্রচলিত আছে। মধ্য আফ্রিকায় এই পাখিকে ‘বৃষ্টির দূত’, পবিত্র, শুভ ও আধ্যাত্মিক বার্তাবাহক মনে করা হয়। ভারতের নাগা উপজাতির কাছে ধনেশের বিশাল ঠোঁট যোদ্ধার সাহস, শক্তি ও সম্মানের প্রতীক। ইন্দোনেশিয়া ও মালয় সংস্কৃতিতে ধনেশ পূর্বপুরুষের আত্মার বাহক হিসেবে বিবেচিত।

বাংলাদেশে পার্বত্য অঞ্চল ঘিরে তিন প্রজাতির ধনেশের দেখা মেলে – রাজধনেশ, কালো ধনেশ এবং গুটিকাগা ধনেশ। এদের মধ্যে রাজধনেশ এবং গুটিকাগা ধনেশ বর্তমানে মহাবিপন্ন পাখির তালিকাভুক্ত (বিলুপ্তির চরম ঝুঁঁকি)। কাঠমজুরি ও কৃষিক্ষেত্রে সম্প্রসারণ, বনাঞ্চলে মানুষের আনাগোনা বৃদ্ধি, প্রজনন মৌসুমে ধরা পড়া ও অবৈধ শিকার এবং খাদ্য ও বাসস্থানের সংকটের কারণে এই প্রজাতিগুলো বিলুপ্তির ঝুঁকিতে পড়েছে।

সংরক্ষণ ও ভবিষ্যৎ

বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন, ২০১২ অনুযায়ী ধনেশ পাখি সম্পূর্ণভাবে সংরক্ষিত ঘোষণা করা হয়েছে। পাখিটি হত্যা, শিকার, বিক্রি বা খাঁচায় রাখা দণ্ডনীয় অপরাধ। পাশাপাশি সাজেক, রেমা-কালেঙ্গা ও সীতাকুণ্ডের মতো বনগুলো সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যা ধনেশ পাখির টিকে থাকার জন্য সহায়ক হবে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সম্মিলিত উদ্যোগের মাধ্যমে সংরক্ষিত বনাঞ্চলে ধনেশদের নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা, পুরোনো গাছ সংরক্ষণ এবং জনসচেতনতা গড়ে তোলার মাধ্যমেই এই বিরল প্রেমের পাখিকে মহাবিপন্নের হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব।

আরও খবর

                   

জনপ্রিয় সংবাদ