সারাদেশ

বৈধভাবে আমদানি বন্ধ থাকলেও ভারতীয় শাড়িতে সয়লাব যশোরের বাজার * গত এক মাসে সোয়া ৫ কোটি টাকার কাপড় আটক!

  প্রতিনিধি 26 March 2025 , 7:51:16 প্রিন্ট সংস্করণ

জেমস আব্দুর রহিম রানা:
যশোরের শার্শা, বেনাপোল এবং চৌগাছা সীমান্তে অভিযান চালিয়ে ২৩ মার্চ ১৪ লাখ ১২ হাজার ১০০ টাকা দামের ভারতীয় শাড়ি, কম্বল, থ্রি-পিস, কিসমিস, ওষুধ, বিভিন্ন ধরনের চকলেট ও কসমেটিকস সামগ্রী জব্দ করেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি)। এ ঘটনায় একজনকে আটক করেছে বিজিবি।
যশোর বিজিবির কমান্ডিং অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্নেল সাইফুল্লাহ্ সিদ্দিকী জানান, যশোর ব্যাটালিয়ন দায়িত্বপূর্ণ সীমান্তবর্তী এলাকায় নিয়মিতভাবে অভিযান পরিচালনা করে ভারতীয় শাড়ি, কম্বল ও কসমেটিকস জব্দ করতে সক্ষম হয়েছে। তিনি জানান, গত এক মাসের ব্যবধানে আমরা ৫ কোটি ১৫ লাখ টাকার শাড়ি-থ্রিপিস ও কসমেটিক্স আটক করেছি। এটা শুধু এক মাসের চিত্র না, সারাবছর ধরেই যশোরের সীমান্ত অঞ্চল দিয়ে ভারতীয় শাড়ি-থ্রিপিস দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করছে। বিপণিবিতানগুলোয় প্রতিদিনই কেনাবেচা হচ্ছে বিপুলসংখ্যক ভারতীয় শাড়ি। প্রতিবেশী দেশ থেকে আনা এসব শাড়ির চাহিদাও দিনে দিনে বাড়ছে। যদিও বাংলাদেশ ও ভারতের আনুষ্ঠানিক বাণিজ্য পরিসংখ্যানে শাড়ি আমদানির কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। ব্যবসায়ী এবং আইন-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, বাংলাদেশে ভারতীয় যেসব শাড়ি দেখা যায়, তার সিংহভাগই দেশে প্রবেশ করেছে অবৈধভাবে ও অননুমোদিত পন্থায়।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, যশোরের সীমান্ত পথে প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ শাড়ি বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। যার সিকি আনাও বিজিবি সদস্যদের হাতে আটক হচ্ছে না। কিছু পণ্য তারা আটক করছে।
চোরাচালানের ক্ষেত্রে দেশে ভারতীয় শাড়ি সীমান্ত এলাকাগুলো দিয়ে প্রবেশ করে প্রধানত বাহক বা এজেন্টদের মাধ্যমে।
ব্যবসায়ী ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এসব শাড়ি দেশে প্রবেশ করে আইন-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বাহিনীর কতিপয় অসাধু সদস্যের সঙ্গে যোগসাজশের ভিত্তিতে। সীমান্ত এলাকা থেকে তা বিভিন্ন রুট ধরে ছড়িয়ে পড়ে ঢাকা-চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। চোরাইপথে প্রবেশ করা এসব শাড়ি এনে জড়ো করা হয় বস্ত্র ও পোশাকের বৃহৎ কয়েকটি পাইকারি বিপণিবিতানে। সেখান থেকে অন্যান্য বিপণিবিতানের ব্যবসায়ীরা নিজ নিজ প্রয়োজন অনুযায়ী তা সংগ্রহ করে নিয়ে যান। আবার চাহিদা ও দাম বেশি হলে আকাশপথেও শাড়ি আনা হয়। সেক্ষেত্রে উড়োজাহাজে শাড়ি আনা হয় ব্যক্তিগত পণ্য হিসেবে বাড়তি ওয়েট চার্জ (ওজনের ফি) পরিশোধ করে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রের তথ্য মতে, বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা ভারতের কলকাতা বা অন্যান্য এলাকায় গিয়ে শাড়ির নকশা পছন্দ করে আসেন। এর পর চালান প্রস্তুত হলে প্রক্রিয়াটিতে যুক্ত হন মধ্যবর্তী এজেন্টরা। তারাই সীমান্ত দিয়ে শাড়ি পরিবহন করে বাংলাদেশে নির্দিষ্ট কিছু গন্তব্যে পৌঁছে দেন। গোটা প্রক্রিয়াটিতে লেনদেন হয় প্রধানত হুন্ডির মাধ্যমে।
নাম না করার শর্তে যশোরের একটি বিপণিবিতানের এক ব্যবসায়ী বলেন, ‘দেশে ভারতীয় শাড়ি আসে প্রধানত বেনাপোল, সাতক্ষীরাসহ কয়েকটি জেলার সীমান্ত দিয়ে। এ শাড়ি নিয়ে আসার প্রক্রিয়ার সঙ্গে দুই দেশের ব্যবসায়ী, দালাল ও সরকারি বিভিন্ন সংস্থার অনেকেই জড়িত বলে শুনতে পাওয়া যায়। আর চোরাচালানের মাধ্যমে আসা শাড়ির রুট নির্ধারণ হয় সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর মধ্যে সমঝোতার ভিত্তিতে। এসব শাড়ি এনে প্রধানত যশোরের বাজারসহ রাজধানীর বঙ্গবাজারসহ বৃহৎ পাইকারি বিতানগুলোয় জড়ো করা হয়। সেখান থেকে বিভিন্ন বিপণিবিতানের ব্যবসায়ীরা তা সংগ্রহ করে নিয়ে যান। অনেক সময় আমরা লটে কিছু শাড়ি ভেজা অবস্থায় পাই। চাহিদা ও ভালো মুনাফার সুযোগ থাকলে শাড়ির বড় শোরুমগুলোর ব্যবসায়ীরা কলকাতা বা অন্যান্য এলাকা থেকে শাড়ি কিনে উড়োজাহাজে বাড়তি ওজনের ফি পরিশোধ করে ব্যক্তিগত পণ্য হিসেবে এসব শাড়ি নিয়ে আসেন। এক্ষেত্রে খরচ একটু বেশি পড়ে ঠিক। কিন্তু শাড়ির দাম ও মুনাফা দিয়েই এ ব্যয় পুষিয়ে নিতে পারেন তারা।’
শহরের এইচএমএম রোডে কমপক্ষে ২০-৩০টি শাড়ির দোকান রয়েছে। প্রায় সবগুলোয়ই ভারতীয় শাড়ি বিক্রি হতে দেখা গেছে। এখনকার বিভিন্ন দোকানের বিক্রয়কর্মী ও ব্যবসায়ীরা জানালেন, এসব দোকানে যেসব কাতান, বেনারসি ও সিল্কের শাড়ি বিক্রি হয়, তার সিংহভাগই ভারত থেকে আসে। তাছাড়া ভারতীয় শাড়ির চাহিদাও বেশি।
ওই সড়কের একটি দোকানের স্বত্বাধিকারী বলেন, দেশীয় শাড়ির পাশাপাশি ‘ভারতীয় শাড়ির চাহিদা বেশি। এখানে যতগুলো শাড়ির দোকান আছে, সবগুলোয়ই ভারতীয় শাড়ি পাওয়া যাবে। এর কারণ হলো ভারতীয় শাড়ি তুলনামূলক সস্তা। দেশী বেনারসি শাড়ির চেয়ে ভারতীয় বেনারসির দাম কম। আবার নকশায়ও আছে ভিন্নতা ও বৈচিত্র্য। আবার সব ধরনের শাড়ি বাংলাদেশে প্রস্তুত হয় না, যেমন কাঞ্জিভরম। তবে এ শাড়ির জনপ্রিয়তা আমাদের দেশে অনেক। সেজন্য ভারতীয় শাড়ি আমদানি করা লাগে।’
গতকাল শাড়ি কিনতে আসা ক্রেতাদের একজন শহরের বেজপাড়ার বাসিন্দা রোশনী আক্তার। তিনি জানালেন, চারটি শাড়ি কিনেছেন, সবক’টিই ভারতীয় কাতান শাড়ি। এগুলো কেনার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘নকশার দিক থেকে ভারতীয় শাড়িতে নতুনত্ব থাকে। তাছাড়া তুলনামূলকভাবে দামেও সস্তা।
আমদানি ও রফতানিতে পণ্যের পরিচয় নিশ্চিতে ব্যবহার করা হয় হারমোনাইজড সিস্টেম বা এইচএস কোড। বাংলাদেশে শাড়ির এইচএস কোড ৫২.০৮। আর ভারতে পণ্যটির এইচএস কোড ৫২০৯৪১২০। ভারতীয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, ২০২২-২৩ ছাড়া গত পাঁচ অর্থবছরের চারটিতেই ভারত থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো শাড়ি আমদানি করেনি বাংলাদেশ। সেবার আমদানির পরিমাণও ছিল খুবই যৎসামান্য। মাত্র ৯০ হাজার ডলার মূল্যের শাড়ি আমদানি হয়েছিল। ২০২৩-২৪ অর্থবছরেও ভারত বাংলাদেশে পণ্য রফতানি করেছে ১১ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। এর মধ্যে শাড়ির অংশ শূন্য। একই চিত্র বাংলাদেশের সরকারি তথ্যেও।
শহরের অভিজাতসহ ছোট-বড় সব বিপণিবিতানেই ভারতীয় শাড়ি বিক্রি হতে দেখা গেছে। এসব দোকানের বিক্রেতাসহ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অনানুষ্ঠানিক পথে বা অবৈধভাবে এসব শাড়ি দেশে প্রবেশের বিষয়টি এখন এক প্রকার ওপেন সিক্রেট। আবার বিষয়টির এক ধরনের গ্রহণযোগ্যতাও তৈরি হয়ে গেছে।
বাংলাদেশে ভারত থেকে আনা শাড়ির বৃহদাংশ প্রবেশ করে স্থল সীমান্ত দিয়ে। আবার নৌপথও ব্যবহার হয়। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলা সাতক্ষীরার ভারতের সঙ্গে সীমান্ত রয়েছে ২৩৮ কিলোমিটার। এর মধ্যে স্থল সীমান্ত ১৩৮ কিলোমিটার। আর জলসীমান্ত ১০০ কিলোমিটার। স্থানীয়রা জানালেন, বিশাল এ সীমান্ত দিয়ে অবৈধপথে বাংলাদেশে ভারতীয় বিভিন্ন ধরনের শাড়ি।
সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোর বাসিন্দারা জানালেন, বিজিবি, পুলিশ ও কাস্টমসের চোখ ফাঁকি দিয়ে চোরাকারবারি বা লাগেজ পার্টি এসব শাড়ি অবৈধভাবে বাংলাদেশে নিয়ে আসছে। এর পর তা সরবরাহ হচ্ছে রাজধানীসহ বিভিন্ন জেলায়। এছাড়া ভোমরা স্থলবন্দর সংলগ্ন ও সাতক্ষীরা শহরের বড় বিপণিবিতানগুলোয় তা বিক্রি করছে।
ভোমরা সীমান্তের জিরো পয়েন্ট সংলগ্ন গাজী পাড়া এলাকার বাসিন্দা মাস্টার শফিকুল ইসলাম জানালেন, সবচেয়ে বেশি চোরাচালান হয় সুন্দরবন সংলগ্ন বিভিন্ন নদীপথে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাতক্ষীরা ৩৩ বিজিবির এক কর্মকর্তা নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে বলেন, দীর্ঘ সীমান্ত পথে কখনো কখনো বিজিবির চোখ ফাঁকি দিয়ে শাড়ি বা অন্যান্য সামগ্রী ঢুকে পড়তে পারে। তবে বিজিবির পক্ষ থেকে সব ধরনের চোরাচালান রোধে কড়া নজরদারি চালু আছে।
বাংলাদেশ-ভারতের বহুল ব্যবহৃত সীমান্ত যশোরের বেনাপোল-পেট্রাপোল। এ সীমান্ত দিয়েও বিপুলসংখ্যক শাড়ি বাংলাদেশে প্রবেশের অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে বেনাপোল কাস্টমের অতিরিক্ত কমিশনার শরিফুল হোসেন আমাদের প্রতিবেদক জেমস আব্দুর রহিম রানাকে বলেন, ‘অনেক যাত্রী ভারত থেকে কসমেটিক্স, কাপড় ও কম্বল নিয়ে আসেন। এতে সরকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অতিরিক্ত মালামাল আনলে আমরা তাদেরকে আটক করছি।’
যশোর বিজিবির কমান্ডিং অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্নেল সাইফুল্লাহ সিদ্দিকী বলেন, ‘সীমান্ত এলাকা দিয়ে কসমেটিক্স ও কাপড় নিয়ে যারাই আসছেন, খবর পেলে আমরা তাদেরকে আটক করছি। গত এক বছরে আমরা বিপুল পরিমাণ কাপড় আটক করেছি।’ ব্যবসায়ীরা বলছেন, অনানুষ্ঠানিকভাবে সীমান্ত দিয়ে আনা হয় বলে সরকারি আমদানি তথ্যে শাড়ির পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না। অনেকে ভ্রমণে গিয়ে ল্যাগেজে করে আনেন। তবে সেখানে খুব বেশি আনা যায় না। ফলে তারা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় ভারতে গিয়ে আগে পছন্দ করে সেখানে অর্ডার করে আসে। সেখান থেকে সংশ্লিষ্ট এজেন্টরা বাংলাদেশে নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছে দেয়। ফলে সরকারের শুল্ক ফাঁকি দেয়া যায় সহজে।
এইচ এম এম রোডস্থ মনষা বস্ত্রালয়ের স্বত্ত্বাধিকারী চিন্ময় সাহা জানান, যশোর ও সাতক্ষীরার সীমান্ত দিয়ে সারা বছরই শাড়ি ও থ্রিপিস আসে। তবে সেগুলো ভালো মানের না। আমাদের দেশি শাড়ির মান ভালো।
যশোর চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি মিজানুর রহমান খান বলেন, ‘অবশ্যই আমরা এ পরিস্থিতির কারণে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছি। অনানুষ্ঠানিক আমদানি বা চোরাচালানের কারণে, স্থানীয় ব্যবসাগুলো পণ্যের দামের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা করতে পারছে না। এছাড়া আমাদের সম্ভাবনাময় ও প্রতিভাবান উদ্যোক্তারা চ্যালেঞ্জ ও অসুবিধার মুখোমুখি হচ্ছেন। এ পরিস্থিতির কারণে তারা নৈতিক ও আর্থিকভাবে হতাশ হয়ে পড়ছেন। ফলস্বরূপ নতুন, সৃজনশীল ও উদ্ভাবনী পণ্য ও সৃষ্টিগুলো বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। নতুন উদ্যোক্তারা নতুন ও সৃজনশীল আইডিয়া তৈরির জন্য কোনো অনুপ্রেরণা পাচ্ছেন না। এর ফলে তাদের বেশির ভাগই ভারতীয় পণ্যের প্রতি ঝুঁকে পড়ছেন। আমাদের দেশের অর্থনীতির ওপর এটি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রভাব ফেলছে। সরকার কাস্টমস শুল্ক, অন্যান্য কর এবং ভ্যাট পাচ্ছে না। আমরা বৈদেশিক মুদ্রা হারাচ্ছি। আমাদের জনগণ কর্মসংস্থান ও উপযুক্ত মজুরি পাচ্ছে না। আমাদের অর্থনীতির একটি বড় অংশ আমদানি-রফতানি শুল্কের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু এ চোরাচালান ও অবৈধ প্রক্রিয়ার কারণে আমরা সেটিও হারাচ্ছি।

Author

আরও খবর

                   

জনপ্রিয় সংবাদ