আনোয়ার সাঈদ তিতু, কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি:-
ঈদযাত্রায় দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ব্রহ্মপুত্র নৌপথে কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধা জেলার বাড়িতে ফেরেন হাজারো মানুষজন। সড়ক পথের দীর্ঘযাত্রা ও যানজটের ধকল এড়াতে ঘরমুখো মানুষের পছন্দের তালিকায় থাকে ব্রহ্মপুত্র নৌপথ। যাত্রী চাপ সামলাতে ঈদে এই নৌপথে অতিরিক্ত নৌযান যুক্ত হয়। তবে এই নৌপথে এবার রয়েছে ডাকাত আতঙ্ক। সঙ্গে ঘাট ইজারাদারের বাড়তি ভাড়া আদায়ের খড়গ ঝুলছে ঘরমুখো যাত্রীদের সামনে।
আসছে ঈদে ব্রহ্মপুত্রে যাত্রায় ডাকাতির আশঙ্কা করছেন ঘাট ইজারাদার, নৌকার মাঝি ও যাত্রীরা। একই আশঙ্কা করছে নৌপুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসন। নৌপুলিশ সদস্যের ঘাটতি এবং আধুনিক নৌযানের অভাবে নিরাপত্তা ঝুঁকি দূর করা সম্ভব হচ্ছে না বলে দাবি নৌপুলিশের। ফলে অনেকটা অরক্ষিত থাকছে নৌপথ।
এদিকে, ঈদযাত্রায় সিরিয়ালের নৌকার বাইরে চলাচল করা নৌকায় বাড়তি ভাড়া আদায়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে নৌকা মালিক সমিতি। রৌমারী ঘাটের ৪৮টি নৌকার মালিকের সমন্বয়ে গঠিত সমিতির পক্ষ থেকে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে মালিকপক্ষ।
ব্রহ্মপুত্র নৌপথে চলা নৌকার একাধিক মাঝি ও যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত বছরের ২১ ডিসেম্বর এবং চলতি বছরের ২৯ জানুয়ারি ও ৯ ফেব্রুয়ারি ব্রহ্মপুত্র নৌপথে তিনটি ডাকাতির ঘটনা ঘটে। প্রায় দুই দশক পর এমন ডাকাতির ঘটনায় এবারের ঈদযাত্রায় শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
নৌকার মাঝি মোসলেম বলেন, ‘গত কয়েকদিন আগে আমার নৌকায় ডাকাতদের হামলা হইছিল। ঈদে যাত্রী বাড়বো। দিনে রাইতে অতিরিক্ত নৌকা চলবো। তখন ডাকাতি হইতে পারে।’
একই আশঙ্কা করে রৌমারী নৌঘাট ইজারাদারের অংশীজন ও ঘাট নৌকা মালিক সমিতির সদস্য নাসির উদ্দিন খান বলেন, ‘যেহেতু একাধিক ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে, তাই নিরাপত্তা আশঙ্কা আছে। ঈদের সময় নিয়মিত সিরিয়ালের বাইরে বাড়তি নৌকা চলাচল করবে। যাত্রীর চাপে রাতেও নৌকা চলাচল করবে। ফলে ডাকাতির একটা শঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।’
ঈদ ঘিরে চার দিন রৌমারী ও রাজিবপুর নৌ ঘাটে যাত্রীদের চাপ থাকে জানিয়ে নাসির উদ্দিন বলেন, ‘এই চার দিনে শুধু রৌমারী ঘাট হয়ে প্রায় ১৫ থেকে ১৬ হাজার ঘুরমুখো যাত্রী ব্রহ্মপুত্র পাড়ি দিয়ে কুড়িগ্রামে যান। ফলে বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে যাত্রীদের ঈদযাত্রা ডাকাতদের ঝুঁকিতে পড়তে পারে।’
‘রৌমারী-চিলমারী নৌপথের দুই-তিনটা বাঁকে নিরাপত্তা জোরদার করলে ডাকাতির কবল থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। দুইশো বিঘার চরের বাঁক, ফেইচকার চরের পশ্চিমের বাঁক এবং খেরুয়ার চরের বাঁকে পাহারার ব্যবস্থা করলে ডাকাতির হাত থেকে যাত্রীদের রক্ষা করা সম্ভব। তবে রাজিবপুর নৌপথে ডাকাতির শঙ্কা বেশি। ওখানে ডাকাতদের আনাগোনা বেশি।’ নৌ নিরাপত্তা বাড়ানো নিয়ে জানান সাবেক এই সেনাসদস্য ও ঘাট ইজারাদার।
ডাকাতদের অবস্থানের বিষয়ে নাসির উদ্দিন বলেন, ‘বেশিরভাগ ডাকাত সদস্যের বসবাস গাইবান্ধার দুর্গম চরাঞ্চলে। এ ছাড়া রাজিবপুর উপজেলার মোহনগঞ্জ ইউনিয়নের দুর্গম চরাঞ্চলেও কিছু ডাকাত থাকে। এসব এলাকা থেকে এসে তারা ডাকাতি করে চলে যায়। এদের প্রতিহত করতে পারলে নৌপথ নিরাপদ থাকবে।’
ঈদে বাড়তি ভাড়া আদায়ের বিষয়ে নাসির উদ্দিন বলেন, ‘রৌমারী ঘাট থেকে পাঁচটি সিরিয়ালের নৌকা চলাচল করে। এগুলোতে অতিরিক্ত কোনও ভাড়া আদায় হবে না। তবে এর বাইরে যেসব নৌকা চলবে সেগুলোতে কিছু বাড়তি ভাড়া আদায় হবে। কারণ ঈদে একপথে যাত্রী যায়। ফিরতি পথে ফাঁকা নৌকা আসে। বাড়তি ভাড়া না নিলে খরচ কুলিয়ে ওঠা সম্ভব নয়। বাড়তি ভাড়া আদায় করতে না দিলে কোনও নৌকা চলবে না।’ একই দাবি করেন ইজারদারদের আরেক সদস্য মশিউর রহমান পলাশ।
ব্রহ্মপুত্র নদে একে একে তিনটি ডাকাতির ঘটনায় নিরাপত্তা শঙ্কায় রয়েছে নৌপুলিশ। মাত্র আট জন সদস্য নিয়ে ব্রহ্মপুত্র যাত্রা নিরাপদ করতে হিমশিম খাচ্ছে চিলমারী নৌপুলিশ ফাঁড়ি। এ অবস্থায় টহল জোরদারে সদস্য সংখ্যা বাড়ানোর পাশাপাশি আধুনিক নৌযানের দাবি জানিয়েছেন ফাঁড়ির ইনচার্জ (আইসি)।
চিলমারী নৌপুলিশ ফাঁড়ির আইসি ইমতিয়াজ কবির বলেন, ‘ফাঁড়িতে মাত্র আট জন সদস্য। এই সংখ্যা যথেষ্ট নয়। ফাঁড়ি পাহারা দিতে অন্তত তিন জন সদস্য রাখতে হয়। নৌপুলিশের সক্ষমতা বাড়াতে সদস্য সংখ্যা বাড়ানোর সঙ্গে আধুনিক জলযান দেওয়া প্রয়োজন। ’
তিনি আরও বলেন, ‘সামনে ঈদ। এই নৌপথে ঈদযাত্রায় প্রচণ্ড চাপ হয়। সড়কপথের ধকল এড়াতে বিপুল মানুষ এই পথে ঈদযাত্রা করেন। নৌপুলিশের জনবল ও সক্ষমতা না বাড়ালে ঈদে নৌপথের নিরপত্তা নিশ্চিত করা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। এ ছাড়া জেলা পুলিশের সহায়তার প্রয়োজন পড়বে।’
রৌমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) উজ্জ্বল কুমার হালদার বলেন, ‘ঈদে ব্রহ্মপুত্রে নৌযাত্রা নিরাপদ করতে বাড়তি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ঘাটে পুলিশের পাহারা থাকবে। নৌপুলিশ নদীতে টহল দেবে। নিরাপত্তার স্বার্থে রাতে একক নৌকা যাত্রা না করে একসঙ্গে দুটি বা তিনটি নৌকা যাত্রা করবে।’
বাড়তি ভাড়া আদায় বন্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে জানিয়ে ইউএনও বলেন, ‘রৌমারী-চিলমারী নৌপথে বাড়তি ভাড়া আদায়ের কোনও সুযোগ নেই। ঈদে নৌকার যাত্রা সময় রাখা হবে না। ধারণক্ষমতা অনুযায়ী একটি নৌকায় সর্বোচ্চ ১০০-১২০ জন যাত্রী হলে সেই নৌকা ঘাট ছেড়ে যাবে। সারাদিন এভাবে চলবে। যাত্রীদের কাছে এক টাকাও বেশি নেওয়া যাবে না। অংশীজনদের নিয়ে বৈঠক করে সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।’
তবে বাড়তি ভাড়া আদায় বন্ধে ইউএনওর এমন দাবির বিপরীত দাবি করেছেন ঘাট ইজারাদারের প্রতিনিধিরা। তারা বলছেন, সিরিয়ালের পাঁচটি নৌকার বাইরে যেসব নৌকা যাত্রী পরিবহন করবে তাতে বাড়তি ভাড়া আদায় করতে না দিলে নৌকা মালিক সমিতি কোনও নৌকা চলাবে না।
সার্বিক বিষয়ে জানতে কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক নুসরাত সুলতানা এবং পুলিশ সুপার মাহফুজুর রহমানের মোবাইল নম্বরে কল দিয়ে তাদের পাওয়া যায়নি।