অন্যান্য

ভরা মৌসুমেও চালের মূল্যবৃদ্ধি: সিন্ডিকেটের কারসাজিতে ক্ষুব্ধ ভোক্তা, অস্বস্তিতে সরকার

  প্রতিনিধি 8 July 2025 , 3:23:17 প্রিন্ট সংস্করণ

বোরো ধানের ভরা মৌসুমেও দেশের বাজারে চালের দাম হঠাৎ করে কেজিপ্রতি ১০ টাকা পর্যন্ত বেড়ে যাওয়ায় চরম ক্ষুব্ধ সাধারণ ভোক্তারা। এই অপ্রত্যাশিত মূল্যবৃদ্ধি সরকারকে ফেলেছে অস্বস্তিতে। উৎপাদন এবং আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে দেশের চালের দামের অসামঞ্জস্যই এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। অভিযোগ উঠেছে, একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট এই মূল্যবৃদ্ধির পেছনে সক্রিয়।
ভোক্তাদের অভিযোগ: সিন্ডিকেটের কালো থাবা
রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা এসএম আকাশ, যিনি একটি বেসরকারি কোম্পানিতে কাজ করেন, জানান ঈদের আগে তিনি ৪ হাজার টাকার কমে ৫০ কেজির এক বস্তা সরু মিনিকেট চাল কিনেছিলেন। কিন্তু ঈদের সপ্তাহখানেক পরেই সেই চালের দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছে সাড়ে ৪ হাজার টাকা। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, “দেশটা যেন মগের মুল্লুক হয়ে গেছে। চালের বাজারে বড় ধরনের সিন্ডিকেট সক্রিয়। তা না হলে ভরা মৌসুমে হঠাৎ করে কেজিতে ১০ টাকা বৃদ্ধির কোনো কারণ নেই।”
উৎপাদন ও আন্তর্জাতিক বাজারে স্বস্তি, দেশে অস্বস্তি
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশের মোট চালের প্রায় ৫৫ শতাংশ বোরো মৌসুমে উৎপাদিত হয়। চলতি বছর বোরোতে রেকর্ড ২ কোটি ১৪ লাখ টন চাল উৎপাদন হয়েছে। বিশ্ববাজারেও চালের দর এখন নিম্নমুখী। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা জানিয়েছে, জুনে আন্তর্জাতিক বাজারে বাসমতিসহ বিভিন্ন জাতের চালের চাহিদা কমেছে, যার ফলে দাম কমেছে শূন্য দশমিক ৮ শতাংশ। এমন অনুকূল পরিস্থিতি সত্ত্বেও দেশের বাজারে চালের দাম বাড়ছে, যা বাজার বিশ্লেষকদের ভাবিয়ে তুলেছে।
ব্যবসায়ীদের ভাষ্য: মিল মালিকদের উপর দায় চাপানো
বিক্রেতারা বলছেন, কোরবানি ঈদের পর হঠাৎ করেই চালের দাম বেড়ে গেছে। খুচরা পর্যায়ে প্রতি কেজি মিনিকেট চালের দাম ৫ থেকে ১০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে এবং গত চার সপ্তাহ ধরে সরু চাল বাড়তি দামেই বিক্রি হচ্ছে। নতুন করে মোটা চালের দামও বস্তাপ্রতি ৫০ টাকা বেড়েছে।
গতকাল সোমবার রাজধানীর সবচেয়ে বড় পাইকারি চালের বাজার বাবুবাজারে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ঈদের তিন-চার দিন পর মিনিকেট চালের দাম বস্তাপ্রতি ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা বেড়েছে, যা পরিবহন খরচসহ খুচরা বাজারে প্রভাব ফেলেছে। নয়াবাজারে গতকাল প্রতি কেজি তীর ডায়মন্ড, সাগর, মঞ্জুর, রশিদ প্রভৃতি ব্র্যান্ডের মিনিকেট চাল ৮০ থেকে ৮২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা ঈদের আগে ৭৫-৭৬ টাকা ছিল। মোজাম্মেল ব্র্যান্ডের মিনিকেট চালের দাম সবচেয়ে বেশি, প্রতি কেজি ৮৬-৯০ টাকা। এছাড়া, খুচরা বাজারে প্রতি কেজি স্বর্ণা (মোটা চাল) ৫৫-৫৮ টাকা এবং ব্রি-২৮ ও ব্রি-২৯ (মাঝারি চাল) জাতের চাল ৬০-৬২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
টিসিবির হিসাব অনুযায়ী, জুন মাসে দেশের বাজারে কেজিতে ৭ থেকে ৮ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে চালের দাম। মিনিকেট ৮২ থেকে ৮৫ টাকায় এবং মোটা চাল ৫৬ থেকে ৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
অভিযোগের তীর অটো রাইস মিল ও করপোরেট হাউসের দিকে
কারওয়ান বাজারের চাল ব্যবসায়ী বাচ্চু মিয়া বলেন, “বাজারে চালের সরবরাহে কোনো সংকট নেই, চাহিদাও বাড়েনি। পরিবহন ব্যয় বা শ্রমিকের মজুরি বাড়ারও কোনো তথ্য নেই। ঈদের পরে হঠাৎ করেই দাম বেড়ে গেছে। বড় কোম্পানিগুলো অনেকটাই সিন্ডিকেট করে চালের দাম বাড়িয়েছে, যদিও তারা ধানের দাম বাড়ার কথা বলছেন।”
আতিকুর রহমান নামে আরেক ব্যবসায়ী বলেন, “সরকারের মজুত নীতিমালার তোয়াক্কা করছেন না অসাধু মজুতদাররা। বোরো মৌসুমের শুরুতেইও করপোরেট ব্যবসায়ীরা হাট-বাজারে আসা অর্ধেকের বেশি ধান কিনে মজুত করে রেখেছেন। কৃষকের ধান সাধারণ মিলারদের হাতে নেই বললেই চলে। এখন তারা ধানের দাম বাড়ার অজুহাতে চালের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে।”
বাবুবাজারের চাল আড়ৎ মালিক আমজাদ হোসেনের মতে, “দেশের ধান-চালের বাজার এখন অটো রাইস মিল এবং করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর দখলে। তারা প্রতিযোগিতা করে ধান কেনায় ধানের বাজার বাড়তি, আর এ কারণেই চালের দাম বাড়ছে।”
ভোক্তা অধিকার ও সরকারের পদক্ষেপ
জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ আলীম আখতার খান বলেন, “আমরা নিয়মিত বাজার মনিটরিং করছি এবং অযৌক্তিকভাবে মূল্য বৃদ্ধির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ অব্যাহত রয়েছে। জেলা প্রশাসন বাজার সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে স্পেশাল অ্যাক্টের আওতায় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে।”
কনসিউমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর নির্বাহী কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হলেও ব্যবসায়ীদের মানসিকতা বদলায়নি। বাজার সিন্ডিকেট একই রয়ে গেছে। গুটিকয়েক অসাধু ব্যবসায়ী বাজারকে অস্থির করে তুলছে। এ ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর নীরবতা রহস্যজনক। আমরা সারা দেশেই চালের মূল্য বৃদ্ধির বিরুদ্ধে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছি, কিন্তু সরকার জনগণের কথা ভাবছে বলে মনে হচ্ছে না।”
কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. সামিউল ইসলাম কিছু অসাধু চালকল মালিক, বড় ব্যবসায়ী ও করপোরেট হাউসের কারসাজিকে অস্থিরতার কারণ হিসেবে উল্লেখ করে সরকারি তদারকি বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি মনে করেন, সরকার মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করলে বাজারে চালসহ অন্যান্য পণ্যের অবৈধ মজুত কমবে এবং দামও কমে আসবে।
সরকারের চেষ্টা ও গণমাধ্যমের সহযোগিতা কামনা
এদিকে, চালের দাম বাড়া প্রসঙ্গে সম্প্রতি কৃষি উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, “চাল আমদানি ও অভ্যন্তরীণ ফলন ভালো হলেও বাজারে দাম বাড়তি। সরকার চালের বাড়তি দর নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করছে। গত বছরের তুলনায় এবার বোরো উৎপাদন ১৫ লাখ টন বেশি হয়েছে, তবুও বাজারে চালের দাম বেড়েছে।” তিনি এই পরিস্থিতিতে গণমাধ্যমের সহযোগিতা কামনা করেন।
বোরো মৌসুমে চালের এই অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি করেছে। সরকারের কঠোর তদারকি এবং সিন্ডিকেট ভাঙার কার্যকর পদক্ষেপই পারে ভোক্তাদের স্বস্তি ফেরাতে।

আরও খবর

                   

জনপ্রিয় সংবাদ