ডোনাল্ড ট্রাম্প যদি ভেবে থাকেন যে তিনি ভারতকে বশে আনতে পারবেন, তবে ঘটনাপ্রবাহ মোটেও তাঁর পরিকল্পনা অনুযায়ী এগোচ্ছে না। নরেন্দ্র মোদি শুধু অনমনীয় অবস্থানই নেননি, তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্টকে কার্যত নীরব আচরণও দেখাচ্ছেন।
আগস্টের শুরুর দিকে ট্রাম্প অপ্রত্যাশিতভাবে ভারতকে কঠোর দ্বৈত শুল্কের আওতায় নেওয়ার পর থেকে তিনি চারবার মোদিকে ফোন করেছেন—এমন খবর প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু প্রতিবারই ভারতের প্রধানমন্ত্রী ফোন ধরতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন।
এই সময়ে মোদি দুবার তাঁর ‘বন্ধু’ ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে কথা বলেছেন এবং তাঁর পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে মস্কোয় পাঠিয়েছেন। চলতি সপ্তাহের শেষে তিনি (মোদি) চীন সফরে যাচ্ছেন। সেখানে তিনি অংশ নেবেন প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং আয়োজিত এক নিরাপত্তা সম্মেলনে, যা অনুষ্ঠিত হবে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় শহর তিয়ানজিনে। দীর্ঘদিনের দূরত্ব সত্ত্বেও বর্তমান পরিস্থিতি তাঁদের মধ্যে আলোচনা আয়োজন করেছে।
২০০১ সাল থেকে ওয়াশিংটন চেষ্টা করে আসছে ভারতকে তাদের প্রভাববলয়ে আনতে; উদীয়মান চীনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধক হিসেবে। কিন্তু ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্র–ভারত সম্পর্কে আগুনে লাগিয়ে দিয়েছেন; প্রথমে ভারতীয় রপ্তানির ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে, এরপর রাশিয়ান তেল কেনার কারণে দিল্লিকে শাস্তি দিতে দ্বিগুণ চাপ প্রয়োগ করে। এটি ব্রাজিল ছাড়া অন্য কোনো দেশের ওপর ওয়াশিংটনের আরোপিত সবচেয়ে কঠোর ব্যবস্থা।
এর সঙ্গে ট্রাম্প অপমানের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিয়েছেন পাকিস্তানের সঙ্গে নতুন বন্ধুত্ব গড়ে তুলে, যে দেশ ভারতের চরম শত্রু। তিনি পাকিস্তানের সেনাপ্রধান ও কার্যত দেশটির প্রধান শাসক আসিম মুনিরকে হোয়াইট হাউসে মধ্যাহ্নভোজে পর্যন্ত আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। মোদি রয়েছেন কার্যত বিচ্ছিন্ন অবস্থায়।
বিশ্লেষকেরা সতর্ক করছেন, এত সরল ও কঠোরভাবে শক্তি প্রয়োগ করে ট্রাম্প উল্টো ফল ডেকে আনছেন—ভারতকে আরও ঘনিষ্ঠ করে তুলছেন মস্কো ও বেইজিংয়ের সঙ্গে।
এ ফাটল ঘটছে এমন সময়ে, যখন সি চিন পিং সাংহাই কো–অপারেশন অর্গানাইজেশনের সম্মেলনে ওয়াশিংটনের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীদের আতিথ্য দিচ্ছেন; এটি মূলত মার্কিন প্রভাব প্রতিহত করতে চীন ও রাশিয়ার উদ্যোগে গঠিত হয়েছিল।
এ সম্মেলনে স্বৈরশাসক নেতাদের উপস্থিতি লক্ষ করা যাচ্ছে—উত্তর কোরিয়ার কিম জং–উন তাঁর বুলেটপ্রুফ ট্রেনে আসছেন, বেলারুশের আলেক্সান্ডার লুকাশেঙ্কো এবং ইরানের মাসুদ পেজেশকিয়ানও থাকবেন আর থাকবেন পুতিন নিজেও।
তবে সবচেয়ে বড় অর্জন মোদি, যাঁর সঙ্গে সির সম্পর্ক হিমালয় সীমান্ত সংঘর্ষের পর থেকে ভয়াবহভাবে তিক্ত হয়ে আছে। ২০২০ সালের জুনে লাঠি ও ইট দিয়ে সংঘটিত সেই সংঘর্ষে ২০ জন ভারতীয় সেনা নিহত হন।
ট্রাম্প ও মোদির এককালে ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল; সে বাস্তবতা সত্ত্বেও এই পুনর্মিলনের চেষ্টা নিজেই এক বিস্ময়কর ঘটনা।
ভালোবাসা আর ‘ব্রোমান্স’
ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠতা, অভিন্ন জনতুষ্টিবাদী প্রবণতা ও ব্যবসায়িক সম্পর্ক একসময় এ দুই নেতাকে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত করেছিল। দুজনই অপরের দেশে বিশাল জনসমাবেশে ভাষণ দিয়েছিলেন—২০১৯ সালে টেক্সাসে ‘হাউডি, মোদি’ সমাবেশে ৫০ হাজার মানুষের সামনে; আর পরের বছর আহমেদাবাদে ‘নমস্তে, ট্রাম্প’ উৎসবে এক লাখ মানুষের সামনে।
তারপর এল কৌশলগত সমন্বয়। চীনের উত্থান উভয় পক্ষকেই উদ্বিগ্ন করে তোলে, ফলে ভারত যোগ দেয় কোয়াডে—যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া ও জাপানের সঙ্গে এক অনানুষ্ঠানিক জোট, যার উদ্দেশ্য বেইজিংয়ের প্রভাব মোকাবিলা করা।
ব্যবসায়িক সম্পর্ক আরও দৃঢ় করে তোলে এই বন্ধনকে। ট্রাম্প পরিবারের ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য ট্রাম্প অর্গানাইজেশন ভারতে গভীর শিকড় গেড়ে বসে, যা ছিল তাদের অন্যতম বৃহৎ বাজার।
ভারতে কমপক্ষে দশটি ট্রাম্প-ব্র্যান্ডেড ভবন নির্মিত হয়েছে, নির্মাণাধীন বা পরিকল্পনায় আছে। কেবল নামের কারণে ট্রাম্প টাওয়ারের ফ্ল্যাটগুলো বিক্রি হয়েছে বাড়তি দামে।
সম্পর্ক বিস্তৃত হয়েছিল ভারতের শীর্ষ ধনী মুকেশ আম্বানির সঙ্গেও, যিনি মোদির ঘনিষ্ঠ সহযোগী ও সুবিধাভোগী এবং একই সঙ্গে গুজরাটেরই সন্তান। এ বছর ট্রাম্পের অভিষেকপূর্ব নৈশভোজে আম্বানি উপস্থিত ছিলেন। তাঁর (ট্রাম্প) বক্তৃতার সময় সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে ছিলেন এবং পরে এক অন্তরঙ্গ সংবর্ধনায় যোগ দিয়েছিলেন।
আম্বানির ছেলের বিয়েতে উপস্থিত ছিলেন প্রেসিডেন্টের কন্যা ইভাঙ্কা ট্রাম্প ও জামাতা জ্যারেড কুশনার। এটি কার্যত পারিবারিক সম্পর্ককেও মজবুত করেছিল।কিন্তু শেষ পর্যন্ত এসব সম্পর্কের মূল্য তেমন কিছুই হয়নি। আম্বানির ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য ও রুশ অপরিশোধিত তেলের ভারতের সবচেয়ে বড় আমদানিকারক রিলায়েন্স হয়ে উঠেছে এখন ট্রাম্পের ক্রোধের প্রধান লক্ষ্য।
আগাম বিপদের ইঙ্গিত
ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদের শুরুর দিকেই সম্পর্কে টান পড়তে শুরু হয়, যখন তিনি বৈশ্বিক বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু করেন। তিনি আশা করেছিলেন, ভারত নতি স্বীকার করবে এবং মার্কিন বিনিয়োগকারীদের জন্য তাদের কড়া সুরক্ষিত কৃষি খাত খুলে দেবে। কিন্তু রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়ার আশঙ্কায় মোদি তা প্রত্যাখ্যান করেন। জবাবে ওয়াশিংটন আরোপ করে ২৫ শতাংশ শুল্ক।
দিল্লির বাণিজ্য অর্থনীতিবিদ বিশ্বজিৎ ধর বলেন, ‘যদি ভারত কৃষি ও দুগ্ধশিল্প খোলার জন্য মার্কিন চাপ মেনে নিত, তবে তা গুরুতর রাজনৈতিক ও নির্বাচনী সমস্যার সৃষ্টি করত।’
এরপর আসে প্রকৃত বিচ্ছেদ। ওয়াশিংটন শাস্তি দ্বিগুণ করে, ‘অয়েল লন্ডারিং’ বা তেল পাচারের অভিযোগ তোলে ভারতের বিরুদ্ধে। মার্কিন ট্রেজারি সেক্রেটারি স্কট বেসেন্ট ‘ভারতের রাজনৈতিকভাবে সংযুক্ত জ্বালানি ধনকুবেরদের’ বিরুদ্ধে, অভিযোগ তোলেন যে তারা রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে ‘লাভবান’ হচ্ছে। যদিও সরাসরি মুকেশ আম্বানির নাম নেননি, তবু স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল ইঙ্গিত কার দিকে।
অভিযোগটি পুরোপুরি ভিত্তিহীনও ছিল না। ইউক্রেন যুদ্ধের আগে ভারত রাশিয়া থেকে খুব কম তেল কিনত। কিন্তু তার পর থেকে ছাড়কৃত মূল্যে তেলের জন্য ব্যয় করেছে ১০০ বিলিয়ন পাউন্ডের বেশি। হেলসিঙ্কিভিত্তিক সেন্টার ফর রিসার্চ অন এনার্জি অ্যান্ড ক্লিন এয়ার বৈশ্বিক জ্বালানিপ্রবাহ নজরদারি করে। তাদের তথ্যমতে, শুধু রিলায়েন্স একাই এ বছরের প্রথম সাত মাসে আমদানি করেছে ৬ দশমিক ৪ বিলিয়ন পাউন্ড মূল্যের অপরিশোধিত তেল।
তবু ওয়াশিংটনের ভারতের ওপর এত মনোযোগ প্রশ্ন তোলে। চীন অনেক বড় ক্রেতা। তুরস্ক, সৌদি আরব ও জাপানও উল্লেখযোগ্য ক্রেতা। ইউরোপ এখনো রাশিয়ার সবচেয়ে বড় গ্যাস গ্রাহক। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর অস্ট্রিয়া ও স্লোভাকিয়া তাদের নির্ভরতা আরও বাড়িয়েছে; অস্ট্রিয়া এখন ৯৮ শতাংশ গ্যাস আমদানি করে রাশিয়া থেকে। অথচ তাদের কারও বিরুদ্ধে একই ধরনের শাস্তির ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
ভারতের ‘বিভ্রান্ত’ সরকার যুক্তি দিচ্ছে, তারা ওয়াশিংটনের সম্মতিতেই রাশিয়ার তেল কিনেছিল এবং তার অনেকটাই পরিশোধন করে বিক্রি করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়নে। তারা আরও বলছে, ভারতের ওপর শুল্ক রাশিয়ার তুলনায় পাঁচ গুণ বেশি, অথচ রাশিয়া স্বয়ংক্রিয়ভাবে পেয়েছে সেই অগ্রাধিকারমূলক হার; যেটির জন্য ব্রিটেনকে হিমশিম খেয়ে আলাদা করে সমঝোতা করতে হয়েছিল।
দিল্লির অনেকের বিশ্বাস, আসল কারণ রাজনৈতিক। ট্রাম্প বারবার দাবি করেছেন, কেবল তাঁর কূটনীতিই মে মাসে ভারত–পাকিস্তানের চার দিনের সামরিক সংঘাত থামিয়েছিল, যা নিয়ে তিনি ৪০ বারের বেশি গর্ব করেছেন। পাকিস্তান তাঁকে কৃতিত্ব দিয়েছে—এমনকি নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনয়নও করেছে। কিন্তু ভারত তা করেনি। এর পর থেকে ওয়াশিংটনের সঙ্গে পাকিস্তানের আগের শীতল সম্পর্ক উষ্ণ হয়ে উঠেছে।
চলুন বাস্তবতার মুখোমুখি হই
যুক্তরাষ্ট্র–ভারতের সম্পর্কে যে শীতলতা তৈরি হয়েছে, তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই যে অপমানিত ও আহত মোদি এখন বিকল্প খুঁজছেন।
এ সংকট চীনের জন্য একপ্রকার উপহার। ট্রাম্প এখন প্রকাশ্যে বিরোধে জড়িয়েছেন তিনটি আঞ্চলিক শক্তির সঙ্গে—ভারত, ব্রাজিল ও দক্ষিণ আফ্রিকা। এর সুযোগ নিয়ে সি চিন পিং বেইজিংকে উপস্থাপন করছেন বেশি দায়িত্বশীল, কম খামখেয়ালি অংশীদার হিসেবে।
তবে মৌলিক পুনর্গঠনের সম্ভাবনা কম। চীন ও ভারত এশিয়ার আধিপত্যের প্রতিদ্বন্দ্বী।
তাদের স্বার্থ অনিবার্যভাবেই সংঘর্ষে জড়াবে। কেবল যুক্তরাষ্ট্রই সে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ভারসাম্য আনতে সক্ষম।
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের সিনিয়র ভারতবিষয়ক বিশ্লেষক প্রভিন দোন্থি বলেছেন, ‘ভারত ও চীনের সম্পর্কে বড় ধরনের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। কিছুটা উন্নতি হতে পারে; কিন্তু ঐতিহাসিক ঘাটতির কারণে সম্পর্ক কখনো প্রকৃত অর্থে বন্ধুত্বপূর্ণ হতে পারবে না।’
তবু সুরে পরিবর্তন আসতে পারে। ওয়াশিংটনের ওপর দীর্ঘদিনের নির্ভরতা নিয়ে শঙ্কিত ভারতীয় রাজনীতিকেরা এখন নিজেদের সঠিক বলে মনে করছেন। মোদি চাপে থাকবেন ভারতের ‘মাল্টি-অ্যালাইনমেন্ট’ নীতি অর্থাৎ সবার বন্ধু, কারও শত্রু নন—এটি পুনরায় জোরালোভাবে তুলে ধরার জন্য।
মোদি হয়তো প্রকাশ্যে অন্তত কোয়াড নিয়ে উৎসাহ কম দেখাবেন, রাশিয়া থেকে আরও অস্ত্র কিনবেন এবং মস্কোর সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক গভীর করবেন। এ বছর শেষ হওয়ার আগেই পুতিনকে ভারত সফরের আমন্ত্রণ জানানো হয়ে গেছে।
তবু যুক্তরাষ্ট্র ভারতের সবচেয়ে বড় রপ্তানিবাজার, বিদেশি বিনিয়োগের প্রধান উৎস এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরক্ষা অংশীদার। মোদি হয়তো ওয়াশিংটনকে শান্ত করার চেষ্টা করবেন—সম্ভবত কম রুশ তেল কিনে তুলনামূলক বেশি মার্কিন গ্যাস আমদানি করে।
দোন্থির ভাষায়, ‘চীন নিয়ে উদ্বেগের কারণে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভারত–মার্কিন সম্পর্ক ভারসাম্যে পৌঁছাবে। ভারত পশ্চিম ও যুক্তরাষ্ট্রের কাছাকাছি যেতে চাইছিল। আপাতত সে গতি কিছুটা শ্লথ হবে, তবে অগ্রগতি চলতে থাকবে।’
তাই সম্পূর্ণ বিচ্ছেদের সম্ভাবনা কম। তবে যেকোনো পুনর্মিলন হবে কঠোর শর্তে। মোদি দেখাতে চান—ভারতের ওপর বিদেশি শক্তির সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়ার দিন শেষ।মোদি ও ট্রাম্প হয়তো সম্পর্ক জোড়া লাগাবেন, কিন্তু ‘ব্রোমান্স’ সম্ভবত শেষ। বিয়ে টিকে থাকবে, কিন্তু তা হবে ভালোবাসাহীন, কেবল প্রয়োজনের তাগিদে।
এড্রিয়ান ব্লমফিল্ড সিনিয়র ফরেন করেসপন্ডেন্ট, দ্য টেলিগ্রাফ