অন্যান্য

ভিক্ষুকমুক্ত’ খুলনায় ভিক্ষুকের ছড়াছড়ি, বিব্রতকর অবস্থায় পথচারীরা

  প্রতিনিধি 20 October 2024 , 6:52:16 প্রিন্ট সংস্করণ

স্টাফ রিপোর্টার

সাত বছর আগে ঢাকঢোল পিটিয়ে খুলনাকে দেশের প্রথম ভিক্ষুকমুক্ত জেলা হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তব চিত্র পুরো উলটো, খুলনায় এখন ভিক্ষুকের ছড়াছড়ি। অভিযোগ রয়েছে, ভিক্ষুক পুনর্বাসনের নামে ঐ সময় সরকারি অর্থ লোপাট করা হয়েছিল।

সরেজমিনে দেখা যায়, খুলনা মহানগরীর রাস্তাঘাট, অলিগলি, নগরীর গুরুত্বপূর্ণ মোড়, বাণিজ্যিক কেন্দ্র, বাস টার্মিনাল, লঞ্চ টার্মিনাল, ট্রেন স্টেশন, হাসপাতাল, মসজিদ, কবরস্থান সবখানেই ভিক্ষুকের ছড়াছড়ি। বাজার দরের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ভিক্ষার পরিমাণ। কয়েক বছর আগে ভিক্ষুকদের ৫০ পয়সা থেকে এক টাকা, দুই টাকা দিলেও তারা হাসিমুখে নিত। এখন পাঁচ টাকার নিচে ভিক্ষুকরা আর ভিক্ষা নিতে চান না। পাঁচ টাকার কম দিলে অনেক ভিক্ষুক তা রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে দেন। আবার ভিক্ষা না দিলে অনেক ভিক্ষুক গালমন্দও করেন। এ কারণে পথচারীসহ সাধারণ মানুষকে প্রায়শই বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হচ্ছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১৬ সালের ১ আগস্ট খুলনা বিভাগকে ভিক্ষুকমুক্ত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। এরপর ২০১৭ সালের ৮ মে তৎকালীন বিভাগীয় কমিশনার আব্দুস সামাদ ঢাকঢোল পিটিয়ে খুলনা জেলাকে ভিক্ষুকমুক্ত ঘোষণা করেন। তখন বলা হয়েছিল খুলনায় আর কখনো ভিক্ষুকের দেখা মিলবে না। কিন্তু বাস্তবে ভিক্ষুক পুনর্বাসনের কার্যকর কোনো উদ্যোগ না নেওয়ায় সেই প্রতিশ্রুতি শুধু ঘোষণাই থেকে গেছে।

খুলনা জেলা সমাজসেবা অধিদপ্তর সূত্র জানায়, ২০১৭ সালে জেলার ৯টি উপজেলায় ৩ হাজার ৫৯৫ জন ভিক্ষুকের নাম নিবন্ধন করা হয়। এরপর তিন ধাপে তাদেরকে প্রায় ৪০ লাখ টাকার ১৪ প্রকার পুনর্বাসন সামগ্রী—সেলাই মেশিন, ভ্যান-রিকশা, হাঁসমুরগি, মুদি দোকান, পুরাতন কাপড় বিক্রি, ডিম বিক্রি, কাঁচামালের ব্যবসা, পিঠা তৈরি, ওজন মাপা মেশিন, ঝাল-মুড়ি ও চানাচুর বিক্রি, আগরবাতি তৈরির মালামাল, টক দই বিক্রি, ঠোঙা বিক্রি, হাঁড়ি-পাতিল বিক্রি, শাকসবজি বিক্রির ভ্যানগাড়ি, চায়ের দোকানের উপকরণ দেওয়া হয়েছিল। ঐ বছরই ৮ মে জেলা প্রশাসন খুলনাকে ভিক্ষুকমুক্ত ঘোষণা করে। এ সময় বিভাগীয় কমিশনার আব্দুস সামাদ পেশাদার ভিক্ষুকদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ারও ঘোষণা দেন।

এদিকে, খুলনা জেলা সমাজসেবা অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য মতে, চলতি অর্থবছরে (২০২৩-২৪) খুলনা জেলায় ১২৩ জন ভিক্ষুককে পুনর্বাসিত করা হয়েছে। এ জন্য ৫ লাখ ২৫ হাজার ৪০০ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। তবে খাতা-কলমে পুনর্বাসনের কথা থাকলেও বাস্তবে এর কোনো প্রতিফলন নেই।

জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, ২০১৭ সালে খুলনা মহানগরসহ জেলার ৯টি উপজেলায় ৩ হাজার ৪৯৭ জন ভিক্ষুক শনাক্ত করা হয়। এর মধ্যে তিন ধাপে ৩ হাজার ৪৬৩ জন ভিক্ষুককে বিভিন্ন ক্ষুদ্র ব্যবসা পরিচালনা করার জন্য বিভিন্ন উপকরণ প্রদান ও রেশনিংয়ের আওতায় এনে পুনর্বাসিত করা হয়। এ সময় ভিক্ষুকমুক্ত কর্মসূচি ফান্ডে জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের এক দিনের বেতন, পুলিশ বিভাগ, বিভিন্ন সংগঠন, সমিতি, এনজিও ও বিত্তবানদের সহযোগিতায় ৮৭ লাখ ৩৪ হাজার ৪৫৭ টাকা সংগ্রহ করা হয়। এ থেকে ৭২ লাখ ১ হাজার ৫৮৫ টাকা পুনর্বাসন কাজে ব্যয় হয়। অবশিষ্ট ১৫ লাখ ৩২ হাজার ৮৭২ টাকা দিয়ে পরবর্তী সময়ে এ কার্যক্রম চলমান রাখার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু পরবর্তীতে এ কার্যক্রম মুখ থুবড়ে পড়ে।

জহুরা নামে এক বৃদ্ধা ভিক্ষুক জানান, তার বাড়ি বটিয়াঘাটা উপজেলার হোগলাডাঙ্গা গ্রামে। ছেলেমেয়ে নেই। সরকারের পুনর্বাসন প্রকল্পের কোনো সুযোগ-সুবিধা তিনি পাননি। নগরীর গল্লামারী ব্যাংক কলোনিতে বসবাসকারী ভিক্ষুক ইউনুস আলী (৬৮) বলেন, ‘অসুস্থতার কারণে গত চার-পাঁচ বছর ধরে ভিক্ষা করতে বাধ্য হইছি। ভিক্ষা না করলি খাবো কি?’

সত্তরোর্ধ্ব ফকির জাফর শেখ থাকেন নগরীর খালিশপুরে। ১০ বছরের বেশি সময় ধরে তিনি ভিক্ষা করছেন। তিনি বলেন, ‘বাড়িঘর নেই, কাজ করতে পারি না। তাই ভিক্ষা করেই আমার জীবন চলে।’

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের ছাত্র রাতুল খান বলেন, কোনো জায়গায় কেনাকাটা করতে গেলে ভিক্ষুকরা ঘিরে ধরে। ভিক্ষুকদের কারণে মানুষকে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হচ্ছে।

খুলনা নাগরিক সমাজের সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট মো. বাবুল হাওলাদার বলেন, দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, দেশের প্রথম ভিক্ষুকমুক্ত জেলা খুলনায় এখনো ভিক্ষুকের ছড়াছড়ি। ভিক্ষুক ছাড়া কোনো জায়গা নেই। মূলত খুলনাকে ভিক্ষুকমুক্ত ঘোষণা ছিল তৎকালীন প্রশাসন ও সরকারের জনগণের সঙ্গে একটি ধাপ্পাবাজি। সেই সময় সরকারের রাজনৈতিক ব্যর্থতা ঢাকা দিতেই ঢাকঢোল পিটিয়ে খুলনাকে ভিক্ষুকমুক্ত প্রথম জেলা ঘোষণা করা হয়েছিল। ঐ সময় ভিক্ষুকমুক্ত করার নামে সরকারি অর্থ লোপাট করা হয়েছে। তদন্ত হলে লুটপাটের তথ্য জানা যাবে।

তিনি আরো বলেন, দিন যত যাচ্ছে ভিক্ষুকের সংখ্যা তত বাড়ছে। ভিক্ষাবৃত্তি বন্ধ করার জন্য রাষ্ট্র ও প্রশাসনকে উদ্যোগ নিতে হবে। সরকার কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করলে ভিক্ষাবৃত্তি কমিয়ে আনা সম্ভব।

খুলনা জেলা সমাজসেবা দপ্তরের উপপরিচালক কানিজ মোস্তফা বলেন, ভিক্ষুকমুক্ত খুলনা ঘোষণার পর অনেকেই ভিক্ষাবৃত্তি ছেড়ে দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে তাদের অনেকেই আবার ভিক্ষাবৃত্তিতে ফিরে এসেছে। তবে এখনো ভিক্ষুকদের বিভিন্ন সময়ে অনুদান দেওয়া হচ্ছে। তাদের পুনর্বাসিত করার চেষ্টা চলমান আছে।

খুলনা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, দেশের প্রথম ভিক্ষুকমুক্ত জেলা খুলনা এটা আমার জানা নেই। তবে, জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে খুলনাকে ভিক্ষুকমুক্ত করার চেষ্টা করছি আমরা।

Author

আরও খবর

                   

জনপ্রিয় সংবাদ