অন্যান্য

মনোহরপুরে হাতপাখার নবজাগরণ তাপপ্রবাহে বাড়ছে জনপ্রিয়তা

  প্রতিনিধি 17 May 2025 , 11:28:08 প্রিন্ট সংস্করণ

জি এম ফিরোজ উদ্দিন

যশোরের মণিরামপুর উপজেলার মনোহরপুর ইউনিয়নে টানা তাপপ্রবাহ ও অসহনীয় গরমে নাকাল জনজীবন। বিদ্যুতের বারবার লোডশেডিংয়ে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে সাধারণ মানুষ। এই বাস্তবতায় আধুনিক বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাখা যখন অচল, তখন গ্রামীণ জনপদের মানুষ খুঁজে নিচ্ছে স্বস্তি ও শান্তির আশ্রয়—তালপাতার হাতপাখায়। ফলে যান্ত্রিক সভ্যতার মাঝেও মনোহরপুরে আবার ফিরে এসেছে হাতপাখার নবজাগরণ।

 

এক সময় যাকে বলা হতো ‘গরিবের এসি’, সেই তালপাতার হাতপাখাই এখন গ্রামে গ্রামে দারুণ চাহিদা পাচ্ছে। স্থানীয় বাজারে চোখ রাখলেই দেখা যায়, হাতে তৈরী এই পাখা কিনতে ভিড় করছেন নানা বয়সী মানুষ। বৈদ্যুতিক পাখা থাকলেও অনেকেই বিকল্প হিসেবে কিনে রাখছেন ঐতিহ্যবাহী এই পাখাটি।

 

মনোহরপুর ইউনিয়নের কয়েকটি পরিবার এখনো হাতপাখা তৈরির কাজের সঙ্গে জড়িত। হাতে তৈরি একেকটি পাখা তৈরিতে লাগে তালগাছের পাতা, বাঁশ, সুতা, চিকন লোহার তার ও রঙ। কয়েকজন নারী একসঙ্গে বসে রঙ ও সাজসজ্জার কাজ করেন, অন্যদিকে কেউ বাঁশ কাটছেন, কেউ পাতার আকার তৈরি করছেন—সব মিলিয়ে চলছে ব্যস্ত প্রস্তুতি।

 

একজন কারিগর জানান, তালপাতা সংগ্রহ করতে যেতে হয় দূর-দূরান্তে। তালপাতা কিনতে হয় ৭ থেকে ৮ টাকা দরে, আর একটি পাতায় তৈরি হয় প্রায় ৮-৯টি পাখা। বাঁশের দাম ১৫০-১৮০ টাকা, যা থেকে শতাধিক পাখার কাঠামো বানানো যায়। এতে প্রতিটি পাখার খরচ পড়ে ৬-৭ টাকা। পাইকারি বিক্রি হয় ১০-১২ টাকায়, আর খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ২০-৩০ টাকায়।

 

মনোহরপুর বাজারের এক বিক্রেতা জানান, ‘‘প্রতিটি পাখা আমি কিনেছি ১০-১৫ টাকায়, আর বিক্রি করছি ২৫-৩০ টাকায়। বিক্রি ভালো হচ্ছে, লোকে খুঁজে খুঁজে নিচ্ছে।’’

 

পল্লী চিকিৎসক ডা. গৌর মল্লিক বলেন, ‘‘প্রায় প্রতি বছরই আমি হাতপাখা কিনি। বাড়িতে বৈদ্যুতিক ফ্যান থাকলেও গরমের সময় হাতে একটা পাখা থাকলে অনেক আরাম লাগে। বিশেষ করে বিদ্যুৎ চলে গেলে এই পাখার বিকল্প নেই।’’

 

হাতপাখা তৈরির অভিজ্ঞ কারিগর চিত্ত রঞ্জন সরকার বলেন, ‘‘এখন বয়স হয়েছে, তাই বেশি কাজ করতে পারি না। তবে এখনও অনেকেই আমার তৈরি পাখা খুঁজে নেন। আধুনিকতার ভিড়ে আমরা নিজের ঐতিহ্য ভুলে যাচ্ছি। আগে মেলায় এসব পাখা পাওয়া যেত, এখন তা অনেকটাই হারিয়ে যাচ্ছে। সমাজে তালগাছও কমে যাচ্ছে, ফলে এই পেশা টিকে থাকাও কঠিন হয়ে পড়ছে।’’

 

হাতপাখার প্রশংসা করে এক নারী ক্রেতা জানান, ‘‘আমার মেয়ের খুব গরম লাগে। তাই একটা হাতপাখা কিনে এনেছি। বিদ্যুৎ চলে গেলে এটা দিয়েই বাতাস করব। এর বাতাসে স্বস্তি আছে।’’

 

স্থানীয়দের মতে, এই প্রাচীন হস্তশিল্প ও ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখতে হলে সরকার ও বেসরকারি সংস্থার পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে। কারিগরদের প্রশিক্ষণ, পৃষ্ঠপোষকতা ও বিক্রয় উৎসাহ দেওয়া হলে তারা এই পেশায় টিকে থাকতে পারবেন। তালপাতার পাখার মতো আমাদের ঐতিহ্য ও শিকড়কেও টিকিয়ে রাখা জরুরি—তবেই ভবিষ্যত প্রজন্ম জানবে তাদের অতীতের গল্প।

আরও খবর

                   

জনপ্রিয় সংবাদ