মাহতিম আহমেদ রাজা
স্কুলশিক্ষক থেকে হলেন রাজনীতিবিদ। এরপর সংসদ সদস্য। পরে প্রতিমন্ত্রী ও মন্ত্রী হন। বাংলাদেশবিরোধী বিশেষ মিশন নিয়ে ভূমি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব তাঁকে দেওয়া হয়—এমন জনশ্রুতি রয়েছে। কিন্তু ৫ আগস্টের পর সব কিছু এলোমেলো হয়ে যায়। দলের শীর্ষ নেত্রীর পদাঙ্ক অনুসরণ করে খুলনা-৫ আসনের এই সংসদ সদস্য পালিয়ে যেতে চেয়েছিলেন পাশের দেশে। হুন্ডি ব্যবসায় তাঁর বিশেষ দক্ষতা ছিল। ঝিনাইদহের মহেশপুর সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালানোর সময় বিজিবির হাতে ধরা পড়েন নারায়ণ চন্দ্র চন্দ। তাঁর নিজের চারিত্রিক স্খলনের চেয়ে পারিবারিক দুর্নীতিই ছিল চোখে পড়ার মতো। এলাকাবাসীর ধারণা, পারিবারিক অপকর্মের কারণেই তাঁর দুটি সন্তানকেই আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হয়।
পতাকাধারী ব্যক্তি হয়েও চন্দ প্রায়ই চলতেন সুন্দরী রমণীদের নিয়ে। তাঁর এক সহচরের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠায় হাসপাতাল থেকে ফিল্মি স্টাইলে ভিকটিমকে তুলে নেওয়ার ঘটনায় আদালতে যে মামলা হয়েছে সেখানেও নারায়ণ চন্দ্র চন্দ ২ নম্বর আসামি।
রবিবার রাতে ঝিনাইদহের মহেশপুর সীমান্ত থেকে ভারতে পালানোর সময় সাবেক মন্ত্রী চন্দ আটক হওয়ার পর গতকাল সোমবার সকালে তাঁর এলাকা খুলনার ডুমুরিয়ায় গিয়ে স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বললে বেরিয়ে আসে তাঁর মুখোশের আড়ালে নানা অজানা কাহিনি। এলাকাবাসী বলছে, দৃশ্যত নিপাট ভদ্রলোক হলেও হেন অপকর্ম নেই যা নারায়ণ চন্দ্র চন্দ বা তাঁর পরিবারের সদস্যরা করেননি। জমি দখল করে ইটভাটা, টাকার বিনিময়ে চাকরি, পদোন্নতি দেওয়া, মনোনয়ন বাণিজ্য—এসব ছিল তাঁর নিত্যদিনের বিষয়।
পারিবারিক দুর্নীতি : নারায়ণ চন্দ্র চন্দের বড় ছেলের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনার সুযোগটি সৃষ্টি হয়েছিল ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী প্রয়াত সালাহউদ্দিন ইউসুফের বদৌলতে। এরপর আর তাঁকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ওই সময়ে আইন কমিশনের সদস্য হওয়ার সুযোগে অনেক বিচারককে চাকরি দেওয়া থেকে শুরু করে বদলি ও অন্যান্য বাণিজ্য করে বনে যান বিপুল অর্থবিত্তের মালিক।
মেজো ছেলের নিয়ন্ত্রণে ছিল ডুমুরিয়া-ফুলতলা অঞ্চল। অনেক পরিবারের কাছ থেকে চাকরি দেওয়ার নাম করে টাকা নিলেও চাকরি দেওয়া হয়নি—এমন অভিযোগও রয়েছে বিস্তর। এ নিয়ে বিরোধের জের ধরেই ২০১৭ সালে তাঁর মেয়ে জয়ন্তী রানী চন্দ ওরফে বেবির আত্মহত্যা বলেও জনশ্রুতি রয়েছে। এছাড়া ঘুষের টাকার ভাগাভাগিকে কেন্দ্র করে ছোট ছেলে অভিজিত চন্দ্র চন্দ হারপিক খেয়ে আত্মহত্যা করেন—এমনটিও শোনা যায়। নগরীর বসুপাড়ার বাসায় চন্দের জামাতা ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী ব্যবস্থাপক প্রভাষ দত্তকে ২০১৮ সালের ৩০ নভেম্বর কেন গুলি করে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল, সেটি নিয়েও ওই সময় গোয়েন্দা সংস্থাগুলো চেষ্টা করেও অজানা কারণে বেশিদূর এগোতে পারেনি।
ডুমুরিয়া বাজারের চা দোকানদার পলাশ ঘোষের ভাই প্রসূন ঘোষকে বন বিভাগে চাকরি দেওয়ার শর্তে চন্দ পরিবারকে দেওয়া হয়েছিল তিন লাখ ৮০ হাজার টাকা। গতকাল সকালে ওই চা দোকানে বসেই এ প্রতিবেদককে প্রসূন ঘোষ বলেন, আজও তিনি পুরো টাকা ফেরত পাননি।
ডুমুরিয়া কলেজে চাকরি দেওয়ার জন্য ইন্টারভিউ দিয়েছিলেন তানজিলা খাতুন নামের এক প্রার্থী। কিন্তু তাঁকে না নিয়ে নেওয়া হয়েছে ইন্টারভিউতে টেকেননি এমন একজনকে। তানজিলার স্বামী মো. সাদিক হোসেন বলেন, ১৮ লাখ টাকাও দেওয়া হয়েছিল।
ফসলি জমিতে ইটভাটা : ডুমুরিয়ার খর্নিয়ার ভদ্রদিয়া পূর্বপাড়ায় গতকাল দুপুরে গিয়ে দেখা যায়, কেপিবি অর্থাৎ কালিপদ ব্রিকস নামের ইটভাটা অনেকটা অরক্ষিত। এলাকার কয়েকজন বলেন, নারায়ণ চন্দ্র চন্দ দুই বছর আগে এই ইটভাটাটি করেছেন স্থানীয় মানুষের ফসলি জমি দখল করে।
স্থানীয় শিমুল দাস বলেন, তাঁর বাবা পঙ্গু। মা মারা গেছেন আগেই। স্ত্রী আর দুটি সন্তান নিয়ে পাঁচজনের সংসারে তিনি একাই উপার্জনক্ষম। দুই বিঘা জমি লিজ নিয়ে তিনি সেখানে ধান ও সবজি চাষ করে সংসার চালাতেন। গত বছর এমন এক দিন সকালে এসে দেখেন কেপিবির মালিক নারায়ণ চন্দ্র চন্দ তাঁর অন্তত ২০ মণ শিম মাটিতে পিষে দিয়েছেন। অসহায় শিমুল এখন দৈনিক মজুরি করে দারুণ কষ্টে সংসার চালান।
কথা হয় অরুণ মল্লিক, রামপ্রসাদ, জয়দেবসহ ভুক্তভোগী অনেকের সঙ্গে। তাঁরা বলেন, নারায়ণ চন্দ্র চন্দ মন্ত্রী হয়ে একযোগে ৩০ বিঘা জমি দখল করে ইটভাটা করেন। ধীরে ধীরে ভাটা এলাকা সম্প্রসারণ করেন জমি দখলের মাধ্যমে। নারায়ণ চন্দ্রের ইটভাটাটি এখনো অনুমোদনহীন। এর সত্যতা স্বীকার করেন পরিবেশ অধিদপ্তরের তৎকালীন বিভাগীয় পরিচালক মো. ইকবাল হোসেন।
হুন্ডির সহযোগী যারা : জনশ্রুতি আছে, নারায়ণ চন্দ্র চন্দের অবৈধ টাকা হুন্ডি করে ভারতে পাঠানো হয় কয়েকজন ব্যবসায়ীর মাধ্যমে। এর মধ্যে কৈয়া এলাকার নদী দখল করে ইটভাটা তৈরি করা এক ব্যবসায়ী যেমন রয়েছেন তেমনি ঢাকার হাজি এয়ার ট্রাভেলসের মালিকের নামও শোনা যায়। রবিবার সীমান্তে গ্রেপ্তার হওয়ার পর ঢাকার একটি বাড়িতে শতকোটি টাকা রেখে যাচ্ছিলেন—এমন খবরটিও খতিয়ে দেখছে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো।
ইউপি নির্বাচনে মনোনয়ন বাণিজ্য : ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দল বিবেচনা না করেই মনোনয়ন দেওয়া হতো, এমনকি নিজস্ব প্রার্থীকে যেকোনোভাবেই জিতিয়ে আনা হতো বলেও এলাকাবাসী জানায়। এ জন্য কোটি কোটি টাকা লেনদেন হতো। তারা বলে, সবাই জানত, অন্য কেউ কোনোভাবে বিজয়ী হলেও পরে তাঁকে আর রাখা হবে না পৃথিবীতে। গত ৬ জুলাই শরাফপুর ইউপি চেয়ারম্যান শেখ রবিউল ইসলাম খুন হওয়ার পর এ বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তবে অনেকে ভয়ে এখনো মুখ খুলছে না।
ডুমুরিয়া সদরের প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সামনের চন্দের নিজ বাড়িতে গিয়ে গেট বন্ধ পাওয়া যায়। ভেতরে কেউ আছে কি না সেটি বোঝার উপায় নেই। ডুমুরিয়া বাজারের একজন ব্যবসায়ী বললেন, তাঁরা অনেকটাই নাজেহাল হয়েছেন চন্দ পরিবারের দ্বারা। তবে তিনি কোনো প্রতিশোধ নিতে রাজি নন। এমনকি মামলাও করবেন না।