প্রতিনিধি 22 August 2025 , 3:56:46 প্রিন্ট সংস্করণ
মৌলভীবাজার প্রতিনিধি
মৌলভীবাজারে এবার আমন ধান আবাদে ব্যস্ত সময় পার করছেন কৃষকরা। তবে জেলার অন্যতম বড় হাওর কাউয়াদিঘিতে দেখা দিয়েছে জলাবদ্ধতা। এতে পানির নিচে তলিয়ে গেছে আবাদি জমি আর বীজতলা। ফসল হারানোর শঙ্কায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন কৃষকরা।
পানি উন্নয়ন বোর্ড দিন-রাত পাম্প চালু রাখলেও কুশিয়ারা নদীতে নামছে না হাওরের পানি।
বৃহস্পতিবার (২১ আগস্ট) সরেজমিন মৌলভীবাজার সদর উপজেলার বড়কাপন, জগতপুর, রায়পুর, আখাইলকুড়া, কাশিমপুরসহ কাউয়াদিঘি হাওরপাড়ে দেখা যায় কোথাও ডুবে আছে বীজতলা। আবার কোথাও ডুবে গেছে রোপন করা ফসলের জমি। রোপা আমন আবাদের মৌসুম শেষ হওয়ার পথে, অথচ অনেক কৃষক এখনো জমিতে লাগাতে পারেন নি আমনের চারা। বর্ষার শেষে দিকে মৌলভীবাজারের বৃহৎ হাওর কাউয়াদিঘিতে দেখা দিয়েছে জলাবদ্ধতা। বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢলের কারণে হাওরের ফসলি জমি এখন পানির নিচে। ডুবে গেছে আমন ধানের আবাদি জমি ও বীজতলা। এতে ফসল হারানোর শঙ্কায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন কৃষকরা।
জগতপুর গ্রামের কৃষক মোত্তালিব মিয়া বলেন, “প্রত্যেক বছর জলাবদ্ধতায় আমরার সব কিছু কাড়িয়া লইয়া যার। অনেক অনেক টাকা পয়সার ক্ষতি গ্রস্থ আর কৃষক অখল ঋনও পরের। এই পানি নিষ্কাশন না হওয়ার কারণে আমরার মতো অনেক গৃহস্থ অখল ক্ষতিগ্রস্ত হই গেছিনগি। পানি ঠিকমতো তারা হিছে না। পানি না হিছার কারণ কিতা ইটা আল্লায় কইতান পারইন”।
আখাইলকুড়া ইউনিয়নের পাগুরিয়া গ্রামের কৃষক মোকাম উদ্দিন বলেন, “তোরা কিছু আবাদ করছিলাম তা-ও পানিয়ে ভুরিয়া নিছে গি। এখন আবার যে ইটা কমি গেলে গি আমন ধান লাগাইতাম পারলাম নে। এবার আমরা কৃষকরা খুব বেশি মরাত,আমরা খুব আটকাত। গতবছরও ১৫-২০ কেয়ার রইয়া লাখ দেড় লাখ টাকা মাইর খাইলাম। সরকার তাকি আমরা ভুর্তকি পাইনা। কিছুই পাইনা”।
রায়পুর গ্রামের কৃষক শহীদ বলেন, “আমি কাওয়াদীঘি হাওরে আমনের আবাদ করছিলাম। আমার আমন নস্ট করি লাইছে জলাবদ্ধতায়। ভাদ্র মাসের মধ্যে যদি পানি নিষ্কাশন না হয় আমরা যে হালি গুলা গজাইছি সব হালি নষ্ট অই যাইবো। যে কোন মূল্যে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করইন।
বড়কাপন গ্রামের কৃষক বাবুল আহমেদ বলেন, “পানি আটকে থাকার কারণের আমরা অনেক কৃষকে মাইর খাইছি। আমরার অনেক আমন ধান পানির নীচে তলিয়ে গেছে। আমরা খুব কস্টের মধ্যে আছি। পানি নামতেছে না। অনেক কৃষক পাম্প হাউজে যায় কিন্তু তারা পানি নামার না”।
একই গ্রামের কৃষক রেজাউল করিম খসরু বলেন, “কাশিম পুর পাম্প হাউজের মাধ্যমে অতিরিক্ত পানি সেচ করে যাতে কৃষি ব্যবস্থাপনা ঠিক রাখা যায়,আমন ধান ঠিকমতো ফলানো যায়, এখানে যে ৮ টি মেশিন আছে এগুলো যদি ঠিকমতো চালানো হতো ১৯ হাজার হেক্টর আবাদযোগ্য জমি পানির নীচে থাকতো না”।
কাউয়াদিঘি হাওরের কৃষকদের দাবি, কাউয়াদিঘি হাওরের পানি নিষ্কাষণের জন্য নির্মিত পাম্প হাউজ যথাযথ সময়ে চালু রাখা। পাশাপাশি হাওরের ছড়া ও নদীগুলো খনন করে ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি করা।
হাওর রক্ষা আন্দোলনের সদর উপজেলা সভাপতি আলমগীর হোসেন বলেন, কাউয়াদীঘি হাওর কিনারে এখন আমন আবাদের ভরা মৌসুম। আমরা অনেকেই বীজতলা তৈরি করছি কিন্তু জলাবদ্ধতার কারণে ধান রোপন সম্ভব হচ্ছে না। সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষের কাছে বার বার আবেদন করেও কোন ইতিবাচক সাড়া পাইনি৷ যার কারণে আমরা ক্ষতি গ্রস্ত হচ্ছি।
তিনি জানান,হাওরের সাথে সংযুক্ত খাল নালা বা ছোট নদী যদি খনন করা হতো তাহলে পানির ধারণ ক্ষমতা বাড়তো। কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, এবার মৌলভীবাজার জেলায় ৯৮হাজার হেক্টর জমিতে আমন ধানের আবাদের লক্ষমাত্রা। এর মধ্যে ৮০ হাজার হেক্টর জমিতে আবাদ করেছেন কৃষকরা।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর মৌলভীবাজারের উপপরিচালক মোঃ জালাল উদ্দিন বলেন, কাউয়াদিঘী হাওরসহ জেলার হাওরগুলোতে খুব একটা জলাবদ্ধতা হবে না। কারণ কাউয়াদীঘি হাওরের কাশিপুর পয়েন্ট সেচ পাস্পগুলো ২৪ ঘন্টা চালু আছে। এগুলো যদি চালু থাকে আমার মনে হয় না আমন আবাদ বিঘ্ন ঘটবে। আমরা আশা করছি, কাউয়াদিঘী হাওরে ৯ হাজার হেক্টর জমিতে আবাদ হবে।
তিনি জানান, এবছর ৯০ পারসেন্ট জমিতে আমন আবাদ হয়েছে। এবছর মওসুমের যে বৃষ্টি পাত এটা আমনের জন্য খুব ভালো। আশা করছি, এবছর লক্ষ্য মাত্রা অর্জিত হবে। পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, কাউয়াদিঘি হাওরের ২৪ হাজার হেক্টর জমির পানি নিষ্কাষণের জন্য কাশিমপুরে রয়েছে ৮টি পাম্প মেশিন। বর্ষা মৌসুমে হাওরের পানি নিষ্কাষন করে এই পাম্প হাউজ। কিন্তু হাওরের ভারসাম্য ও জীববৈচিত্র রক্ষায় নিম্নাঞ্চলের জলাবন্ধতা নিরসন সম্ভব নয় বলে জানায় পানি উন্নয়ন বোর্ড।
মৌলভীবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ খালেদ বিন অলীদ বলেন, “পাম্প হাউস প্রধানত করা হয়েছিল মে-জুন মাসে বোরো ফসলের সময় আগাম বন্যা বা বৃস্টিপাতের ফলে ছড়ার পাহাড়ি ঢল নেমে আসে তাতে হাওরের পাকা ধান যাতে ডুবে না যায় সে কারণে পাম্প হাউজের মাধ্যমে পানি কুশিয়ারা নদীতে নিষ্কাশন হয়। সাধারণত হাওর এলাকায় হাওরের কান্দিতে আমান ধান উৎপাদন হলেও হাওরের নিচু অঞ্চলে আমান ধান উৎপাদন সম্ভব হয় না। আগস্ট মাসের ডিজাইন লেভেল হতে হাওরে পানির সমতল কম থাকলেও বর্তমানে হাওরের নিচু অঞ্চলে আমান ধান রোপন করায় তা পানিতে ডুবে যায়।
তিনি বলেন, বর্ষাকালে (জুলাই-আগাস্ট) ছড়ার মাধ্যমে যে পরিমান পানি আসে সে পরিমান পানি বর্তমান পাম্প হাউজের মাধ্যম নিস্কাশন করা সম্ভব হবে না অর্থ্যাৎ বর্তমান পাম্প হাউজের মাধ্যমে বর্ষাকালে (জুলাই-আগাস্ট) বৃষ্টিপাত অব্যহত হাওড়ের পানির লেভেল ৭.৫০ রেখা সম্ভব হবে না। হাওরের নিচু অঞ্চলে আমান রোপন করতে হলে হাওড়ের পানির লেভেল ৭.৫০ রাখতে হবে। এক্ষেত্রে নতুন পাম্প হাউজ নির্মাণ করতে হবে। তাছাড়া বর্ষাকালে হাওড়ের পানির লেভেল ৭.৫০ রাখলে হাওড়ের পরিবেশ ও জীব বৈচিত্র্য, মৎস্য হুমকির মুখে পতিত হবে কিনা সে বিষয়ে বিস্তারিত সমীক্ষা প্রয়োজন।