যশোর, ৩১ জুলাই ২০২৫,
দুপুর ৩:৫৫ (স্থানীয় সময়): যশোরের অভয়নগর ও মনিরামপুর উপজেলার ৪৫টিরও বেশি গ্রাম ফের জলাবদ্ধতার শিকার। টানা বৃষ্টি আর নদীগুলোর পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার বেহাল দশায় বসতবাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ধর্মীয় স্থাপনায় পানি ঢুকে চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন হাজার হাজার মানুষ। প্রশ্ন উঠেছে, বছরের পর বছর ধরে চলা এই দুর্ভোগের কি কোনো স্থায়ী সমাধান নেই?
অবিরাম বর্ষণ ও বেহাল নিষ্কাশন ব্যবস্থা
যশোরের বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান বিমানঘাঁটির আবহাওয়া বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, গত জুনে যেখানে গড় বৃষ্টিপাত ছিল ২৯৯ মিলিমিটার, সেখানে চলতি জুলাইয়ের ২৯ তারিখ পর্যন্ত তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৫০ মিলিমিটারে। এই অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত ভবদহ এলাকার ৫২টি বিল প্লাবিত করেছে, যার পানি উপচে আশপাশের গ্রামগুলোতে ঢুকছে।
ভবদহ অঞ্চলের পানি মূলত মুক্তেশ্বরী, টেকা, শ্রী ও হরি নদীর মাধ্যমে নিষ্কাশিত হয়। কিন্তু পলি জমে নদীগুলো নাব্যতা হারানোয় পানি প্রবাহে মারাত্মক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে। আর এই কারণেই বৃষ্টির পানি আটকে গিয়ে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে।
জলাবদ্ধতার শিকার গ্রামের তালিকা
ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির তথ্যমতে, মনিরামপুরের কুলটিয়া ইউনিয়নের ১৪টি গ্রাম, চলিশা ইউনিয়নের ৫টি, সুন্দলী ইউনিয়নের ১০টি, পায়রা ইউনিয়নের ৫টি, হোগলাডাঙ্গা ইউনিয়নের ৮টি এবং নেহালপুর ইউনিয়নের ৩টি গ্রামসহ মোট ৪৫টিরও বেশি গ্রাম ইতিমধ্যে প্লাবিত হয়েছে। প্রতিদিন এই সংখ্যা বাড়ছে। ফসলের জমি, বাড়িঘর, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং উপাসনালয় সবই এখন পানির নিচে।
অভয়নগর উপজেলার ডহর মশিয়াহাটী গ্রামের দিলীপ বিশ্বাস (৪০) আক্ষেপ করে বলেন, "বৃষ্টির সাথে ওপরের দিকের জল চাপ দেওয়ায় জল বেড়েই চলেছে। উঠানে বাঁশের সাঁকো তৈরি করেছি। জল আরেকটু বাড়লে ঘরে ঢুকবে।" একই গ্রামের সুভাষ বিশ্বাস জানান, "খুবই খারাপ অবস্থায় আছি। যেভাবে জল বাড়ছে, তাতে এবারও জলাবদ্ধতা ভয়াবহ রূপ নেবে।"
প্রতিশ্রুতি ও দীর্ঘসূত্রতার এক দীর্ঘ ইতিহাস
ভবদহ অঞ্চলের জলাবদ্ধতা নিরসনে সরকারিভাবে নানা প্রকল্প নেওয়া হলেও দুর্ভোগ যেন নিত্যসঙ্গী। ভুক্তভোগীরা বলছেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার অভাবই এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী। ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক রনজিত বাওয়ালি সরকারের আশ্বাসের পরেও কাজের দীর্ঘসূত্রতাকে দায়ী করেছেন। তিনি বলেন, "সরকারের পক্ষ থেকে আমডাঙ্গা খাল ৮১ কিলোমিটার নদী খনন এবং টিআরএম (জোয়ারাধার) করার প্রক্রিয়া গ্রহণ করলেও তার দীর্ঘসূত্রিতার জন্য আবারও বিপর্যয় সৃষ্টি হচ্ছে।"
তিনি আরও জানান, ভবদহ স্লুইসগেটের ২১টি ভেন্টের মধ্যে বর্তমানে মাত্র চারটি থেকে ছয়টি গেট খোলা। বাকি গেটগুলো খুলে দিলে দ্রুত পানি বেরিয়ে গিয়ে সম্ভাব্য বিপর্যয় থেকে মানুষকে রক্ষা করা যেত। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং দ্রুত সরকারি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে বাধার কারণেই এই দীর্ঘসূত্রিতা সৃষ্টি হচ্ছে বলে মনে করেন তিনি।
রনজিত বাওয়ালি জরুরি ভিত্তিতে আমডাঙ্গা খাল সংস্কার, নদী খনন ও টিআরএম বাস্তবায়নের জোর দাবি জানিয়েছেন। উদ্ভূত পরিস্থিতি পর্যালোচনা ও করণীয় নির্ধারণের জন্য আগামী ৪ আগস্ট বিকাল ৩টায় মসিহাটি স্কুলে ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির এক সভা অনুষ্ঠিত হবে বলে তিনি জানান।
চীনা বিশেষজ্ঞ দলের পরিদর্শন ও স্থায়ী সমাধানের আশা
এমন ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যেই গত মঙ্গলবার (২৯ জুলাই) ভবদহের ২১ ভেন্ট স্লুইস গেট পরিদর্শন করেছে চীনা বিশেষজ্ঞ একটি দল। চিফ প্লানার ঝু জমিং-এর নেতৃত্বে এই দলে শিন ইগোশিন, সহকারী চিফ ইঞ্জিনিয়ার হুং হুজিওং, ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজার জাং ঝিজান, ডেং ইউজি, চেইন ইয়াংসহ অনেকে উপস্থিত ছিলেন। এসময় যশোর জেলা প্রশাসক আজাহারুল ইসলাম, যশোর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী পলাশ কুমার ব্যানার্জীসহ স্থানীয় প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
যশোর জেলা প্রশাসক আজাহারুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানান, "ভবদহ অঞ্চলের জলাবদ্ধতা সমস্যার স্থায়ী সমাধানে বর্তমান সরকার আন্তরিক। এ কারণেই চীনা বিশেষজ্ঞ দল ভবদহ অঞ্চল পরিদর্শনে এসেছেন। পরিদর্শন শেষে তারা তাদের মতামত সরকার বরাবর উপস্থাপন করবেন। সেই অনুযায়ী এবার স্থায়ী সমাধানে উদ্যোগ নেওয়া হবে।"
তবে, চীনা বিশেষজ্ঞ দলের এই পরিদর্শন কি ভবদহের মানুষের বছরের পর বছরের এই দুর্ভোগের স্থায়ী অবসান ঘটাতে পারবে, নাকি এটিও কেবল দীর্ঘসূত্রতার আরেক নাম হয়ে থাকবে – সেটাই এখন দেখার বিষয়। এলাকাবাসী অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন একটি স্থায়ী সমাধানের জন্য, যা তাদের জীবনকে স্বাভাবিক ছন্দে ফিরিয়ে আনবে।