আন্তর্জাতিক

যুক্তরাষ্ট্রের হাত থেকে বাঁচতে মেয়ে সেজে লুকিয়ে ছিলেন পানামার স্বৈরশাসক নরিয়েগা

  প্রতিনিধি 28 January 2025 , 11:49:18 প্রিন্ট সংস্করণ

নিউজ ডেস্ক

 

 

যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচিত হওয়ার পর এমনকি শপথ নেওয়ার পরও পানামা খালের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বারবার কথা বলেছেন। প্রয়োজনে শক্তি প্রয়োগের কথাও উড়িয়ে দেননি তিনি। তাঁর এই কথাবার্তার কারণে পানামার সাবেক স্বৈরশাসক ম্যানুয়েল অ্যান্তনিও নরিয়েগার নামটি আবার আলোচনায় উঠে আসছে। পানামায় অভিযান চালিয়ে তাঁকে ধরে এনেছিল যুক্তরাষ্ট্র।যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে সাহসের পরিচয় দিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দাবাহিনীর একসময়ের ঘনিষ্ঠ ও পানামার স্বৈরশাসক ম্যানুয়েল অ্যান্তনিও নরিয়েগা। তবে মার্কিন বাহিনীর অভিযান শুরুর পর ভয় পেয়ে তিনি ভ্যাটিকানের দূতাবাসে আশ্রয় নিয়েছিলেন। ধরা পড়া থেকে বাঁচতে নারী সেজে তিনি ওই দূতাবাসে লুকিয়েছিলেন।

 

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পানামা খালের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে কথা বলার পর আবার নরিয়েগার নামটি আলোচনায় উঠে আসছে। নরিয়েগার বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে নির্দেশ দিয়েছিলেন জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশ। যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের বাইরে গেলে তারা কতখানি নির্মম হয়ে উঠতে পারে, নরিয়েগা তার একটি জ্বলন্ত উদাহারণ হতে পারে।বার্তা সংস্থা রয়টার্সের তথ্য অনুযায়ী, পানামার সাবেক স্বৈরশাসক ম্যানুয়েল নরিয়েগা দীর্ঘদিন যুক্তরাষ্ট্রের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছেন। তবে তাঁর নিষ্ঠুর শাসন, মাদক কারবারে ধৈর্যহারা হয়ে পড়েন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশ। নরিয়েগাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে ও পানামার নিয়ন্ত্রণ নিতে ২৮ হাজার মার্কিন সেনা পাঠান তিনি। একপর্যায়ে সেনা অভিযান চালিয়ে নরিয়েগাকে ধরে যুক্তরাষ্ট্রে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।

 

২০১৭ সালে ৮৩ বছর বয়সে মারা গেছেন নরিয়েগা। ১৯৯০ সালের জানুয়ারি মাসে যুক্তরাষ্ট্রের সেনারা তাঁকে তুলে নিয়ে যান। এর আগে দুই সপ্তাহজুড়ে তাঁকে ধরতে মার্কিন বাহিনী বিশেষ অভিযান চালায়। এর পর থেকে তাঁর জীবন কেটেছে যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, পানামার কারাগারে। তাঁর বিরুদ্ধে হত্যা, মাদক কারবারসহ নানা অভিযোগ আনা হয়েছে।

 

মার্কিন সিনেট উপকমিটির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, নরিয়েগা যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের জ্ঞাতসারেই ‘মাদক ক্লেপটোক্রেসি’ গড়ে তুলেছিলেন যা ওই গোলার্ধের প্রথম মাদক সাম্রাজ্য বলা চলে। এ সাম্রাজ্য গড়ে তুলতে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা নিজের স্বার্থে ব্যবহার করেছিলেন। অবশ্য গ্রেপ্তারের পর নরিয়েগা অভিযোগ করে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র তাঁর সঙ্গে খেলা করেছে। তাঁকে হাতমোজার মতো ব্যবহার করেছে।কারাগারে থাকা অবস্থায় নরিয়েগা বলেন, ‘আমার নেতৃত্বে পানামা যা করেছে, তা সবার জানা। পানামা খোলা বইয়ের মতো।’

 

কিন্তু ২০১১ সালে নরিয়েগা যখন হুইলচেয়ারে করে পানামা ফেরেন, তখন তিনি অনেকটাই দুর্বল হয়ে যান। যে শক্তিশালী জেনারেল হিসেবে পরিচিত ছিল তাঁর, তা আর ছিল না। তিনি নিজের কুখ্যাত শাসনের জন্য দেশবাসীর কাছে ক্ষমা চেয়েছিলেন। তবে বিরোধী নেতা–কর্মীদের খুনের দায়ে জীবনের বাকি দিনগুলো নির্জন বন্দী হিসেবে তাঁকে কাটাতে হয়।নরিয়েগার উত্থান যেভাবে

১৯৩৪ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি পানামা সিটিতে জন্ম নরিয়েগার। তাঁর জন্মস্থান থেকে যুক্তরাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত পানামা খালের দূরত্ব ছিল খুবই কম। তরুণ বয়সে তিনি সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। স্মার্ট ও নির্মম হিসেবে নরিয়েগার পরিচিতি ছিল। তাঁর সাইক্লপস বা মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ পরিচালনার প্রতি ঝোঁক ছিল। তিনি মাও সেতুং, হো চি মিন এবং ত্রয়োদশ শতাব্দীর মঙ্গোলীয় যুদ্ধবাজ চেঙ্গিস খানের ভক্ত ছিলেন।১৯৬৮ সালে সেনা অভ্যুত্থানে ওমর তোরিজোসের সঙ্গী ছিলেন নরিয়েগা। পরে তোরিজোস তাঁকে গোয়েন্দাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ দেন। তিনি সেনাবাহিনীর দুর্নীতিগ্রস্ত বিভিন্ন চুক্তি তদারকি করতেন এবং এর নির্মম গোপন পুলিশ বাহিনী পরিচালনা করতেন।

 

১৯৭০-এর দশকের গোড়ার দিক থেকে সিআইএর সহযোগী হিসেবে কাজ করেন নরিয়েগা। ওয়াশিংটনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে পানামা, এল সালভাদর এবং নিকারাগুয়ায় মার্কন বাহিনীকে সহায়তা করতে শুরু করেন তিনি। এর পর থেকে নিজের স্বার্থে তিনি যুক্তরাষ্ট্র ও পানামার কর্মকর্তাদের কাজে লাগাতে শুরু করেন।১৯৮১ সালে তোরিজোস বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হলে দুই বছরের মধ্যেই পানামার শাসক হন নরিয়েগা। কিন্তু এর আগে থেকেই তিনি কলম্বিয়ার মাদকসম্রাট পাবলো এসকোবারের মতো অনেককেই যুক্তরাষ্ট্র, পানামাসহ বিভিন্ন স্থানে মাদক পাচারে সুযোগ করে দেন। এর বিনিময়ে ব্যাপক অর্থ পেতে থাকেন তিনি। ১৯৭৮ সাল নাগাদ নরিয়েগার এসব কর্মকাণ্ড যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ধরা পড়ে। ১৯৮৩ সাল নাগাদ তাঁর বিরুদ্ধে অনেক প্রমাণ জোগাড় করা হয়। কিন্তু ওই সময়কার স্নায়ুযুদ্ধের সময় মধ্য আমেরিকায় বামপন্থী উত্থান ঠেকাতে পানামাকে বাফার অঞ্চল হিসেবে দেখা হয়।১৯৮৫ সালে পানামার নির্বাচনে নিকোলা আদ্রিতো বারলেতা জয়ী হলেও নরিয়েগা তা মেনে না নেওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হতে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের শর্ত ছিল, পানামা খাল পানামার হাতে তুলে দিতে ওই নির্বাচন হতে হবে।নরিয়েগার বিরুদ্ধে ভূরাজনৈতিক ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হওয়ার অভিযোগও আনা হয়েছিল। কিউবার নেতা ফিদেল কাস্ত্রো এবং লিবিয়ার নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফিকে গোপনে সমর্থন দেন তিনি। এ ছাড়া অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডেও জড়িয়ে পড়েন। ১৯৭০ সাল থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত তাঁর বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের মাদক নিয়ন্ত্রণ কার্যালয়ে ৮০টি ফাইল জমা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের কৌঁসুলিরা তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনার আট সপ্তাহ আগে সিআইএ বলে, তাঁর বিরুদ্ধে যথেষ্ট প্রমাণ নেই। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের ধৈর্য কমছিল।অপারেশন জাস্ট কজ

১৯৮৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে নরিয়েগা কোকেইন চোরাচালান ও অর্থপাচারে অভিযুক্ত হন। যুক্তরাষ্ট্র চাপ বাড়াতে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দেয়। কিন্তু দমে যাননি নরিয়েগা। ১৯৮৯ সালে তাঁকে পানামার জাতীয় পরিষদ সর্বোচ্চ নেতা ঘোষণা করে এবং যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। ১৯৮৯ সালের ২০ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের সেনারা ‘অপারেশন জাস্ট কজ’ নামে পানামায় অভিযান শুরু করে এবং নরিয়েগাকে খুঁজতে শুরু করে।নরিয়েগা পালিয়ে পানামা সিটির ভ্যাটিকান দূতাবাসে আশ্রয় নেন। তিনি সেখানে নারী সেজে যান। মার্কিন সেনারা দূতাবাসে তল্লাশি চালায়। নরিয়েগা ১৯৯০ সালের ৩ জানুয়ারি আত্মসমর্পন করেন। ১৯৯২ সালের ফ্লোরিডায় তাঁর ৪০ বছরের কারাদণ্ড হয়। ১৭ বছর কারাগারে থাকার পর ২০১০ সালে তাঁকে ফ্রান্সে পাঠানো হয়। সেখানে অর্থপাচারের অভিযোগে কারাগারে যান তিনি।

 

কারাগারের স্মৃতিকথায় নরিয়েগা লেখেন, মধ্য আমেরিকায় স্নায়ুযুদ্ধে ওয়াশিংটনের পক্ষে কাজ না করায় তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। এ ছাড়া তিনি জাতীয়তাবাদী বীর হতে চেয়েছিলেন। তবে তাঁর দাবি অনেকেই মানতে পারেননি। ২০১১ সালে পানামা কারাগারে ফেরার আগেই পানামা অনেকটাই বদলে যায়। ২০১৪ সালের শুরুতেই সরকার তাঁর বিলাসবহুল ভবন ভেঙে ফেলে।যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতাগ্রহণের পর পানামা খালের দিকে নজর দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত এই প্রেসিডেন্ট গত সোমবার তাঁর অভিষেক অনুষ্ঠানে প্রয়োজনে পানামা খালের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার হুমকি দিয়েছেন।সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার (১৯৭৭-৮১) পানামা খাল পানামা সরকারের কাছে হস্তান্তরের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। পানামা খাল চুক্তি যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটে পাস হয় ১৯৭৮ সালে। জিমি কার্টার এই চুক্তির পক্ষে সিনেটের দুই-তৃতীয়াংশের বেশি সদস্যের ভোট আদায় করতে পেরেছিলেন।পানামা খাল পানামা সরকারের কাছে ফেরত দেওয়াটাকে ন্যায্য মনে করতেন জিমি কার্টার। ওয়াশিংটন যেহেতু তখন পর্যন্ত মধ্য আমেরিকায় আধা ঔপনিবেশিক নীতি অনুসরণ করত, তাই জিমি কার্টারের পানামা খাল ফেরত দেওয়ার মধ্য দিয়ে ওই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন যুগের সূচনা হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়েছিল।জিমি কার্টার পানামা খাল চুক্তি সই করেছিলেন—এ কথা বলার পাশাপাশি এটাও বলা দরকার, পরবর্তী সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের দুই দলের প্রেসিডেন্টরাই চুক্তিটির শর্ত মেনে চলেছেন। এসব প্রেসিডেন্টের মধ্যে রয়েছেন রোনাল্ড রিগ্যান, জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশ ও বিল ক্লিনটন। বিল ক্লিনটনের দ্বিতীয় মেয়াদের মাঝামাঝি ১৯৯৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর পানামা খাল পরিচালনার দায়িত্ব সম্পূর্ণভাবে পানামা সরকারের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

Author

আরও খবর

                   

জনপ্রিয় সংবাদ