তোফাজ্জল ইসলাম, সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি
সুনামগঞ্জের এক তরুণের নীরব বিপ্লব বদলে দিয়েছে হাজারো মানুষের ভাগ্য। তিনি মো. তৈয়বুর রহমান—যার একাগ্রতা, দায়িত্ববোধ ও মানবিক চেতনার গল্প আজ রক্তদানের আন্দোলনে এক প্রেরণার নাম।
তৈয়বুর রহমান এখন পর্যন্ত ১৬২৮ জনেরও বেশি রোগীর জন্য রক্ত সংগ্রহ ও সরবরাহে সহায়তা করেছেন। প্রতিটি রক্তব্যাগ যেন একেকটি জীবন, আর তার হাত ধরে নতুন জীবন ফিরে পেয়েছেন অসংখ্য মানুষ। এই পরিসংখ্যান শুধু সংখ্যা নয়—এ এক একটি পরিবারের কান্না থেমে যাওয়ার গল্প।
তার রক্তদানের যাত্রা শুরু হয় কয়েক বছর আগে, এক আত্মীয়ের রক্ত সংকটের সময়। সেই অসহায় মুহূর্ত তাকে নাড়া দেয়। প্রতিজ্ঞা করেন—"আর কেউ যেন রক্তের জন্য হাহাকার না করে।" তখন থেকেই তিনি যুক্ত হন স্বেচ্ছাসেবী কাজে।
তৈয়বুর বর্তমানে জেলার বিভিন্ন ব্লাড ডোনেশন গ্রুপ, বিশেষ করে ‘ব্লাড লিংক সুনামগঞ্জ’, অনলাইন প্ল্যাটফর্ম এবং সরাসরি যোগাযোগের মাধ্যমে রক্তদাতা ও রোগীর পরিবারের মাঝে সেতুবন্ধন গড়ে তুলেছেন। দিনের বেলায় হোক কিংবা মধ্যরাতে—যখনই কেউ রক্তের জন্য আহ্বান জানায়, তৈয়বুর ছুটে যান নিঃসংকোচে।
জেবাদুর রহমানের ছেলে তৈয়বুর রহমান সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার লক্ষণশ্রী ইউনিয়নের বাহাদুরপুর গ্রামের বাসিন্দা। একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরির পাশাপাশি তিনি এই মানবিক কাজ করে যাচ্ছেন দৃঢ় সংকল্পে।
একটি সংগঠন, অসংখ্য কর্ম
ব্লাড লিংক সুনামগঞ্জ—এই সংগঠনের মাধ্যমেই তৈয়বুরের রক্ত সংগ্রহ ও দান কার্যক্রম চলছে আরও গুছিয়ে।
গত ৫ বছরে সংগঠনটি ২৫৬৭ ব্যাগ রক্ত সরবরাহ করতে পেরেছে।
আয়োজন করেছে ১০টি ফ্রি ব্লাড গ্রুপিং ক্যাম্পেইন, যেখানে ৩২২৬ জনের রক্তের গ্রুপ নির্ণয় করা হয়।
শুধুমাত্র ২০২৪ সালেই ১৪৩৭ ব্যাগ চাহিদার বিপরীতে ১৩০২ ব্যাগ রক্ত সরবরাহ করা হয়, যার মধ্যে ৯৫০ ব্যাগই এসেছে তৈয়বুরের একক চেষ্টায়।
২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ৫১৬ ব্যাগ চাহিদার বিপরীতে ৪৬০ ব্যাগ রক্ত সরবরাহ, যার মধ্যে তৈয়বুর একাই জোগাড় করেন ৩৬৯ ব্যাগ।
সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা হুমায়ুন ফারুক আলমগীর এবং সহ-প্রতিষ্ঠাতা কামরুজ্জামান কামরুল জানান, “২০২৪ সালে তৈয়বুর রহমান আমাদের সংগঠনের সবচেয়ে সক্রিয় রক্তসেবী হিসেবে চিহ্নিত হন।”
দুর্যোগেও মানবতা
২০২২ সালের ভয়াবহ বন্যায় সিলেট ও সুনামগঞ্জে সংগঠনটি পরিচালনা করে ৪টি ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প ও ত্রাণ কার্যক্রম।
পাশাপাশি বিশ্বম্ভরপুরে ‘মানবতার দেয়াল’ স্থাপন করে গৃহহীনদের জন্য পোশাক ও প্রয়োজনীয় জিনিস বিতরণ করা হয়।
২০২৪ সালে ফেনী ও মৌলভীবাজারের আকস্মিক বন্যায় বাস্তবায়ন করা হয় ত্রাণ কার্যক্রম ও ঘর নির্মাণ প্রকল্প।
মানবতার ফেরিওয়ালা
স্থানীয় চিকিৎসক ও সাধারণ মানুষ তৈয়বুর রহমানকে ‘মানবতার ফেরিওয়ালা’ বলে ডাকেন।
সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতালের এক চিকিৎসক জানান, “রক্ত সংকট আমাদের অন্যতম চ্যালেঞ্জ। তৈয়বুরের মতো স্বেচ্ছাসেবীরা তা লাঘব করতে প্রশংসনীয় ভূমিকা রাখছেন।”
তৈয়বুর রহমানের আশা—“দেশের প্রতিটি যুবক যদি অন্তত একবার রক্ত দান করে, তাহলে দেশে রক্ত সংকট বলে কিছু থাকবে না। আমি শুধু শুরুটা করেছি, চলার পথটা সবার।”