কে.এম. মোজাপ্ফার হুসাইন
প্রেম—একটি শব্দ, অথচ বহুমাত্রিক ব্যথার নাম। সভ্যতার শুরু থেকে আজ অবধি প্রেম, বিরহ, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির শত শত গল্প মানবজাতির হৃদয়কে নাড়িয়ে দিয়েছে বারবার। সাহিত্যের পাতায়, সংগীতের সুরে, কিংবা নিঃশব্দ দীর্ঘশ্বাসে প্রেমের এই রূপান্তর বারবার ফিরে এসেছে। তবে বিস্ময়করভাবে, ইতিহাসের পরতে পরতে দেখা যায়—এই প্রেমে সবচেয়ে বেশি আত্মাহুতি দিয়েছেন পুরুষরাই।
পারস্যের নিজামি গঞ্জভীর ‘লায়লা-মজনু’, কিংবা ফেরদৌসির ‘খসরু ও শিরিন’—প্রেম কাহিনীর এসব নায়কদের পরিণতি বড় করুণ। প্রেমে পাগল কায়েস হয়ে যান ‘মজনু’; শিরিনের মৃত্যুর মিথ্যে খবরে আত্মঘাতী হন ফরহাদ।
কবি নজরুলও লিখেছেন,
"তুমি তোমার সুখ নিয়ে রও, থাকুক আমার চোখের জল!"
এই আত্মবিসর্জনের ধারা আজও থামেনি। ইতিহাসের পৃষ্ঠায় উঠে আসা বাস্তব চরিত্র বিজু—যার জন্য আজীবন অবিবাহিত থেকে গেছেন প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব জয়নাল হাজারী। নিজের সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন—
"ইতিহাসে হাজারো পুরুষ প্রেমে ব্যর্থ হয়ে অবিবাহিত থেকেছে, কিন্তু কোনো নারীই তার প্রেমিককে না পেয়ে সারাজীবন কুমারী থাকেনি।"
বাংলা গানের কিংবদন্তি জেমস যখন গাইলেন "কবিতা, তুমি স্বপ্নচারিণী হয়ে খবর নিও না"—সেই কবিতারও বিয়ে হয়ে যায়। শিল্পী আইয়ুব বাচ্চু সেই ব্যথায় গেয়ে ওঠেন,
"আজ কবিতা অন্য কারো, সেও দু’হাতে স্বপ্ন উড়ায়।"
সমসাময়িক সংগীতেও প্রেমে পরাজিত পুরুষের দীর্ঘশ্বাস ধ্বনিত—প্রয়াত শিল্পী খালিদ গেয়েছেন,
"এক মহাকাল ব্যথা রেখেছে যে বুকের পাঁজরে—ব্যথা কি বুঝাও তুমি তারে?"
এই ব্যথা পুরুষের অন্তরে গেঁথে যায়, কখনো নিঃশব্দে, কখনো উন্মাদনায়। শহরের অলিতে গলিতে দেখা যায় প্রেমে ব্যর্থ হয়ে পথভ্রষ্ট কিছু মানুষ, যারা হারিয়েছে সব, এমনকি নিজের জ্ঞানও। অথচ নারী হৃদয়ের প্রেম হারানোর দুঃখ সমাজে তেমনভাবে দৃশ্যমান হয় না।
শুধু এক লতা মঙ্গেশকর ছিলেন ব্যতিক্রম, যিনি গেয়েছিলেন,
"প্রেম একবারই এসেছিল নীরবে, আমারই এ মনের অজান্তে"—
তিনিও অবিবাহিত ছিলেন আজীবন।
ইতিহাসের পাতায় ফিরে দেখা...
মজনু লায়লার মৃত্যুসংবাদে মরুভূমিতে ঘুরে বেড়ান, পাথরে খোদাই করেন কবিতা। ফরহাদ পাহাড় কাটতে কাটতে প্রেমিকার মিথ্যে মৃত্যুসংবাদে আত্মহনন করেন। জয়নাল হাজারী বিজুর প্রতীক্ষায় অচলায়তন।
সবই এক মহাকাব্যিক পরিণতি—যেখানে প্রেম হয়তো পায়নি মঞ্জিল, কিন্তু সৃষ্টি করেছে চিরকালীন সাহিত্য, সংগীত ও যন্ত্রণার ইতিহাস।
প্রেমের গাণিতিক ব্যাখ্যা হয় না...
ভালোবাসা কখনোই হিসেব-নিকেশে চলে না। প্রেম হয় পাগলের মতোই। হিসাবী মানুষ প্রেম করতে পারে না—এ সত্য যুগে যুগে প্রমাণিত। তাই আজও যারা প্রেমে পড়ে পাগল হয়ে যান, ইতিহাসে তারাই আসন পান।