প্রতিনিধি 30 December 2024 , 12:03:54 প্রিন্ট সংস্করণ
মা তখনো জানতেন না ঢাকায় তার আদরের ছোট ছেলে মামুন আর বেঁচে নেই। ঢাকার গণঅভ্যুত্থানের খবরও জানতেন না তিনি। ছেলের সঙ্গে তার সর্বশেষ কথা হয়েছিল ১৮ জুলাই। সে সময় ছেলে তাকে বলেছিল চিকিৎসার জন্য বাবাকে ক্লিনিকে নিয়ে যেতে। এজন্য কত টাকা লাগবে, তাও জানতে চেয়েছিল সে। আর সে রাতেই শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী সরকারের নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে রামপুরায় শহীদ হন তিতুমীর কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের মাস্টার্সের ছাত্র ও শরীয়তপুরের এক দরিদ্র পরিবারের সন্তান মোহাম্মদ মামুন মিয়া।
তার মরদেহ গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার সময় পথে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ ক্যাডাররা লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্স আটকে ড্রাইভারকে মারধর এবং গাড়িটিকে ধলেশ্বরী নদীতে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। তাদের হাতে-পায়ে ধরে পার পান লাশের সঙ্গে থাকা লোকজন। এরপর লাশ বাড়িতে নিয়ে গেলে কবর দিতে বাধা দেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ নেতারা। তারা হুমকি দেন, মামুনকে এই গ্রামে কবর দিলে তার লাশ উঠিয়ে অন্যত্র ফেলে দেওয়া হবে। সেখানেও তাদের হাতে-পায়ে ধরে লাশটি দাফন করা হয়। এ বিষয়ে জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে দুই লাখ ও আসসুন্নাহ ফাউন্ডেশন থেকে এক লাখ টাকা পেয়েছেন বলে জানান মামুনের পরিবারের সদস্যরা।
শহীদ মামুনের বাড়ি শরীয়তপুর সদর উপজেলার শৌলপাড়া ইউনিয়নের চরচিকন্দি গ্রামে। তিনি ছিলেন দরিদ্র কৃষক আব্দুল গনি মাদবর ও গৃহিণী মা হেনা বেগমের চার সন্তানের মধ্যে সবার ছোট। পড়াশোনার পাশাপাশি ফ্রিল্যান্সিং করে নিজের ও পরিবারের খরচ চালাতেন তিনি। চেয়েছিলেন ভালো আয় করে পরিবারের দারিদ্র্য ঘুচাবেন। এজন্য চাকরি নিয়ে বিদেশে যাওয়ার কথা ছিল তার। কিন্তু এরই মধ্যে শুরু হয় সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। অধিকার আদায়ের ওই আন্দোলনে বন্ধুদের সঙ্গে অংশ নেন মামুন।১৮ জুলাই দুপুরে আন্দোলনে অংশ নিয়ে বাসায় ফেরেন মামুন। রাতে আবারও কর্মসূচিতে যাওয়ার আগে ফোনে তার কথা হয় মায়ের সঙ্গে। এ সময় মায়ের কাছে দোয়া চান মামুন। মা ছেলেকে নিষেধ করেন আন্দোলনে যেতে। কিন্তু মাকে অভয় দিয়ে মামুন বলেছিলেন, ‘তুমি চিন্তা করো না মা, আমার কিছু হবে না।’ এটাই ছিল তাদের মধ্যে শেষ কথা।
রাতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নিতে রামপুরায় যান মামুন। এদিন আন্দোলন দমনে রাজধানীতে কারফিউ জারি করা হয়েছিল। কিন্তু কারফিউ ভেঙে ছাত্রদের সঙ্গে যোগ দেন সাধারণ মানুষও। তীব্র হয়ে ওঠে আন্দোলন। রামপুরায় পুলিশ ও বিজিবির সঙ্গে পতিত সরকারের দলীয় সশস্ত্র ক্যাডাররাও অবস্থান নিয়েছিল। আন্দোলনকারীদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার এক পর্যায়ে গুলি করতে শুরু করে নিরাপত্তা বাহিনী।
এ সময় বিজিবির ছোড়া একটি বুলেট এসে মামুনের কানের ওপরে লেগে চোখ দিয়ে বের হয়ে যায়। লুটিয়ে পড়েন মামুন। আশপাশে থাকা বন্ধুরা তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যান। এক বন্ধু মামুনের সেজ ভাই রুবেলকে ফোন করে মামুনের গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর জানান।
আমার দেশকে মামুনের ভাই রুবেল বলেন, ফোন পেয়ে হাসপাতালে গিয়ে দেখি মামুনের মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগানো, জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে সে। ডাক্তাররা মামুনের অপারেশন করেন। ওষুধ আনতে যাওয়ার আগে মামুনকে লাইফ সাপোর্টে দেখে যান তিনি। ফিরে এসে দেখেন তার আদরের ছোট ভাই আর নেই। তিনি বলেন, ‘আমাকে নিয়ে আমার ভাইয়ের অনেক স্বপ্ন ছিল। আমাকে বিদেশে পাঠাবে, না হয় ব্যবসার ব্যবস্থা করে দেবে। কিন্তু সেই আশা আর পূরণ হলো না। অভাবের সংসারে মামুনই ছিল আমাদের ভরসা।’চোখ মুছতে মুছতে মামুনের মা আমার দেশকে বলেন, ‘আমার মামুন কয়, মা দুপুরে আন্দোলনে গেছিলাম। আমি কইলাম তুমি আন্দোলনে গেছো ক্যান বাবা? মামুন কয়, বাইরে যাওয়া যায় না, হাসিনা গুলির হুকুম দিছে। রাইতে আবার আন্দোলনে যামু, আমার লাইগ্যা দোয়া কইরো মা। এইটা বইলাই ফোন কাইট্টা দিছে। এত কইলাম রাইতে বাইরে যাইওনা, আমার কথা শুনল না। পরে কি হইছে তা আর কইতারি না।’
তিনি বলেন, সকালবেলা ফোন দেই; কিন্তু ফোন আর ধরে না। ওর কোনো বন্ধু জানি ফোন ধরে। আমি কইলাম আমি মামুনের আম্মু, তুমি কেডা? মামুনের কাছে দেও কথা কমু। সে কয়, আমি তো অনেক দূরে আছি, বাসায় যাইয়া ফোন দিমু। এই বইলাই ফোন কাইট্টা দিছে। বাসায় গিয়া আর ফোন দিব কই থাইকা, আমার মামুন তো আর দুনিয়াতে নাই।’
আদরের ছোট সন্তান হারানো এই মা আরও বলেন, ‘মামুনের আশা ছিল দাদার কবর পাকা করবো, মসজিদ-মাদরাসা উঠাইবো, বিদেশে গিয়া পহেলা টাকা পাঠাইয়া ওর বাবারে মাদ্রাজ নিয়া চিকিৎসা করাইবো। সব আশা শেষ অইয়া গেলো।’
মামুনের বন্ধু জাকির আমার দেশকে বলেন, ‘আমরা একসঙ্গে আন্দোলন করেছি। তার লাশ বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার সময় যাত্রাবাড়ী-মাওয়া রাস্তার মাঝামাঝি আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের ক্যাডাররা অ্যাম্বুলেন্স আটকে ড্রাইভারকে মারধর করে। লাশসহ অ্যাম্বুলেন্স ধলেশ্বরী নদীতে ফেলে দিতে চায় তারা।মামুনের বৃদ্ধ বাবা অসুস্থ। কাজকর্ম করতে পারেন না। সংসার চালানোর মতো লোক নেই। বড় ছেলে রাজমিস্ত্রির কাজ করেন। তিনি পরিবার নিয়ে আলাদা থাকেন। মেজ ছেলে গার্মেন্টসে সামান্য বেতনে চাকরি করেন। তিনিও পরিবার নিয়ে ঢাকায় থাকেন। মামুনের মা বলেন, ‘বড় দুই ছেলের সংসারই ঠিকমতো চলে না। আমাদের কীভাবে দেখবো? মামুনই আমাদের সংসার চালাইতো। সরকার এখন বেকার রুবেলকে একটা চাকরি দিলে সে সংসারের হাল ধরতে পারতো।’
শহীদ মামুনের স্মৃতি রক্ষার্থে শরীয়তপুরের চৌরঙ্গী মোড়ের নামকরণ ‘শহীদ মামুন চত্বর’ করার দাবি করেছে তার পরিবার
—আমারদেশ