প্রতিনিধি 19 October 2024 , 1:53:00 প্রিন্ট সংস্করণ
জেমস আব্দুর রহিম রানা:
গত ১৫ অক্টোবর প্রকাশিত হয়েছে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম পাবলিক পরীক্ষা এইচএসসি’র ফলাফল। এবারো এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণার পর বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, পরীক্ষায় কাঙ্ক্ষিত জিপিএ-৫ না পেয়ে গুটিকয়েক পরীক্ষার্থী হতাশা ও কটুকথা থেকে বাঁচতে আত্মহত্যা করেছে। প্রায় প্রতিবছর (যা ক্রমাগত বাড়ছে) এ রকম দুর্ভাগ্যজনক আর মর্মান্তিক আত্মহননের ঘটনা আমাদের ব্যথিত, মর্মাহত ও প্রশ্নের সম্মুখীন করায়। এ কথা হয়তো অস্বীকার করার উপায় নেই, পরীক্ষার ফলাফল-পরবর্তী পারিবারিক ও সামাজিক নানা চাপে ভোগে শিক্ষার্থীদের অনেকেই। তাদেরই কেউ কেউ সেই চাপ সহ্য করতে না পেরে মানসিক অবসাদ থেকে এমন কিছু ভুল করে বসে যা সত্যিই ভীষণ বেদনার ও দুঃখজনক।
জীবনে সাফল্য জরুরি। কিন্তু অভিভাবকসহ আমাদের সবার জানা প্রয়োজন পরীক্ষায় জিপিএ-৫ বা বেশি নম্বর পাওয়াই শুধু জীবনের লক্ষ্য নয়। অন্যের পাওয়া বেশি নম্বর বা ভালো ফলাফল যখন আমরা আমাদের সন্তানকে দেখিয়ে তা পেতে স্বাভাবিক উৎসাহ না দিয়ে অশুভ প্রতিযোগিতায় ফেলি তখন কোনো কারণে পরে তা পেতে ব্যর্থ হয়ে সন্তান যদি কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে তার দায়ভার আমরা এড়াতে পারি না। ভুলে গেলে চলবে না, জীবনে প্রায় সবাই কিছু ক্ষেত্রে সফল, কিছু ক্ষেত্রে ব্যর্থ। এই উপলব্ধি অভিভাবক হিসেবে আমাদের বুঝতে ও সন্তানদের বোঝাতে হবে।
আমাদের বর্তমান বাস্তবতায় কিছু অভিভাবক ভাবেন, হয়তো তার সন্তানের পরীক্ষায় প্রথম হতে পারা, জিপিএ-৫ পাওয়া বা মেডিক্যাল, বুয়েট, চুয়েট বা নামি দামি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে টিকতে পারার মধ্যেই জীবনের সার্থকতা! কিন্তু আমরা ভুলে যাই, অনেক পুঁথিগত বিদ্যা অর্জন করেও একজন মানুষ নৈতিক চরিত্র এবং সামাজিক নৈপুণ্যের ক্ষেত্রে চরম দীনতার মধ্যে থাকতে পারে, অভিভাবকরা নিশ্চয়ই তা মানবেন, তবুও কেন এই চাওয়া?
সমাজে মানবিক সংস্কৃতির বাতাবরণ তৈরি হয় যথার্থ শিক্ষার মাধ্যমে। কিন্তু আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার আধার সংস্কৃতির উপস্থিতি নেই বললেই চলে। কয়েক বছর ধরে আমাদের পাবলিক পরীক্ষাগুলোয় সংখ্যাগত বিচারে পাসের হার বেড়েছে, কিন্তু সামাজিক মূল্যবোধ কি সেই হারে বেড়েছে বা সেই অর্থে মেধাবী প্রজন্ম কি তৈরি হয়েছে? অনেক ক্ষেত্রেই উত্তর হচ্ছে, না। বিগত সময়ে আমরা দেখেছি, গোল্ডেন জিপিএ-৫ পেয়েও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে, বুয়েট এবং মেডিক্যালের ভর্তি পরীক্ষায় তারা মেধার স্বাক্ষর রাখতে পারছে না, এমনকি ভালো ফলাফলে উত্তীর্ণ কিছু শিক্ষার্থী শুদ্ধ ইংরেজি তো বটেই ভালোভাবে মাতৃভাষায়ও কিছু লিখতে অসুবিধা বোধ করে। আবার অন্যদিকে সমাজে কিছু ক্ষেত্রে চরম অধঃপতিত হয়েছি আমরা। এই পরীক্ষানির্ভর বাস্তবতায় আমরা ভুলে যাই, সমাজে শিক্ষিত জনগোষ্ঠী তৈরি হলেই তাদের জ্ঞানী বলা যায় না। আর জ্ঞানী হলেও তারা তো বিজ্ঞ মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ নাও হতে পারেন, এই উপলব্ধি আমাদের যত দ্রুত হবে ততই মঙ্গল।
শিক্ষার হার, প্রাথমিকে ঝরে পড়া হ্রাস বা প্রায় শতভাগ পাসের সমাজই একটি আলোকিত ও সপ্রাণ সমাজ নয়। একটি সুস্থ, সুন্দর, সজীব ও প্রাণবন্ত সমাজের জন্য যে মানবিক ও সহনশীল শিক্ষা তৈরি করা প্রয়োজন সে রকম মানবিক, সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধের শিক্ষা আমরা আদৌ নাগরিকদের মাঝে ছড়াতে পারিনি। আমাদের সার্টিফিকেটনির্ভর শিক্ষা আজ অনেকটা বৈষয়িক শিক্ষায় শিক্ষিত নাগরিক সমাজ তৈরি করছে। সহশিক্ষা কার্যক্রমে আজ আমাদের উৎসাহ কম বা কিছু অভিভাবকের ভাষায়, শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়, কলেজ, প্রাইভেট টিউটর, কোচিং সেন্টারে সময় দিয়ে অন্য কিছুতে সন্তানদের ঠিক সময় হয়ে ওঠে না। কিন্তু এভাবে ধীরে ধীরে আমরা আমাদের শিক্ষার্থীদের প্রাণবন্ত শৈশবকে প্রাণহীন করে ফেলছি।
আমাদের শিক্ষার্থীদের একটা বড় অংশেরই বর্তমানে লাইব্রেরিতে গিয়ে নানান বই পড়ার অভ্যাস প্রায় নেই বললেই চলে। শিক্ষার্থীরা যদি এভাবে নিজেদের আত্মচৈতন্যের বৃন্তে আটকে রাখে তা হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সুস্থ মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হবে, যার ক্ষতিকর প্রভাব ছড়িয়ে পড়বে সমাজের নানা স্তরে। এই যে আমাদের এত ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ও বিভিন্ন ডিগ্রিধারীর সংখ্যা বাড়ছে, কিন্তু তবুও তো দেখি সমাজজুড়ে মূল্যবোধের সংকট, আদর্শের অনটন আর সংবেদনশীলতার ভীষণ অভাব। প্রায় সব ক্ষেত্রেই অরাজকতা, ক্ষমতালিপ্সা আর নিয়মহীনতাই যেন আমাদের নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা মানব হয়েও মানবিক না হয়ে ইদানীং অনেকেই দানবের আচরণ করছি, সহনশীল আজ আমরা অপরকে হতে বলি, কিন্তু নিজে তার চর্চা করি না।
পত্রিকার পাতায় বা বিভিন্ন মাধ্যমে আমরা যখন আমাদের কোনো শিক্ষার্থী বা নাগরিকের নেতিবাচক সংবাদ পাই, তখন তা আমাদের ব্যথিত করে, যাদের কাছ থেকে আমাদের প্রত্যাশা মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষের, কিন্তু তাদেরই কেউ কেউ যখন নেতিবাচক সংবাদের শিরোনাম হয়, তখন নাগরিক হিসেবে আমরা উদ্বিগ্ন, দুঃখিত না হয়ে পারি না। তাই অভিভাবকদের বলি, আপনি আপনার সন্তানকে ভালো ফল করতে বলবেন, তাতে দোষের কিছু নেই এবং সেটাই যৌক্তিক। কিন্তু সেই সঙ্গে মানুষ হওয়ার সাধনা যদি না করে, তবে চূড়ান্ত বিচারে ফলাফল শূন্য। পরীক্ষায় ‘প্রথম’ হওয়ার জন্য নয়, আমাদের প্রতিযোগিতা হওয়া উচিত সত্যিকারের জ্ঞান ও বৈদগ্ধ লাভের জন্য। শুধু মুখস্থবিদ্যায় ভর করে একজন শিক্ষার্থী হয়তো পরীক্ষায় প্রথম হতে পারেন, কিন্তু প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারেন কী? কীভাবে প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হয় সে বিষয়ে অবহিত হওয়াই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। অনেক বিষয় মুখস্থ রাখার ক্ষমতা বা বিদ্যাকে শিক্ষা বলে না। আমাদের মনে রাখা উচিত, আদর্শ, মূল্যবোধ আর সংস্কৃতির মেলবন্ধন ছাড়া শুধু পরীক্ষায় ‘প্রথম’ হতে চাওয়া শিক্ষা সমাজের জন্য ক্ষতিকারক। তাই আমাদের এই সর্বনাশা পরীক্ষানির্ভর শিক্ষা হতে বের হতে হবে, তবেই হবে মুক্তি জাগবে প্রাণ। পরিশেষে আমরা যেন ভুলে না যাই, পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পাওয়া হয়তো আমাদের অনেকের কাছেই জীবনের অনেক কিছু, কিন্তু তা কখনই জীবনের সব নয়। কারণ শুধু পরীক্ষার ফলাফল কখনই কারও জীবনকে নির্ধারণ করে না।
লেখক: জেমস আব্দুর রহিম রানা।
সিনিয়র গণমাধ্যমকর্মী ও কলামিস্ট।
কেন্দ্রীয় নির্বাহী সদস্য, বাংলাদেশ মফস্বল সাংবাদিক ফোরাম (বিএমএসএফ), নির্বাহী সম্পাদক, দৈনিক চেতনায় বাংলাদেশ ও সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার, দৈনিক নাগরিক ভাবনা, ঢাকা।