অন্যান্য

শোকাহত বাংলাদেশ, খুঁজছে জবাব

  প্রতিনিধি 21 July 2025 , 6:03:14 প্রিন্ট সংস্করণ

আকস্মিক শোকের ছায়ায় ঢেকে গেল বাংলাদেশ, ঢাকার উত্তরায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার মহাট্র্যাজিক দিনটি ভেঙে দিয়ে গেল হৃদয়। হতবিহ্বল, অতবাক দেশের মানুষ খুঁজছে জবাব; সরকারপ্রধান থেকে সাধারণ মানুষ বিমর্ষ চিত্তে নিহত ও আহত, যাদের বেশিরভাগ শিশু শিক্ষার্থী; তাদের পরিবারের প্রতি শোক জানিয়ে এই ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করার প্রতি জোর দিচ্ছেন। কীভাবে, কার দোষে বিমানটি আঁছড়ে পড়ল; সেই প্রশ্নেরও ‍উত্তর খুঁজছে মানুষ। কেনবইবা সুপারসনিক প্রশিক্ষণ বিমান ঢাকায় উড়াতে হলো বা উড়ানো হয়? তাও জানতে চাইছে অনেকে। সেই সঙ্গে ঢাকার বড় বড় সব হাসপাতালে চলছে পুড়ে যাওয়া শিশু শিক্ষার্থী ও তাদের শিক্ষকদের চিকিৎসা। সরকার বলছে, চিকিৎসায় কোনো ঘটতি নেই।ঢাকার উত্তরার দিয়াবাড়ি এলাকায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ভবনে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়ে হতাহতের ঘটনায় শোক জানিয়ে রাতে যে ভিডিওবার্তা দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস, সেখানেও তিনি অসহায়ত্ব প্রকাশ করে বলেছেন, শিশুদের মা-বাবাদের কী জবাব দেব।

সোমবার (২১ জুলাই) দুপুর ১টা ৬ মিনিটের দিকে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে আঁছড়ে পড়ে প্রশিক্ষণ বিমানটি। আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর-আইএসপিআরের দেওয়া সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, এই ঘটনায় অন্তত ২০ জন নিহত এবং ১৭১ জন আহত হয়েছে।এই ঘটনায় দেশজুড়ে শোকের ছায়া নেমে আসে। গণমাধ্যম আর সামজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শোকবার্তা হৃদয় ছুয়ে গেছে। শিল্প-সাহিত্য ও ক্রীড়াঙ্গন থেকে সারা দেশের মানুষ বেদনার দিনটিতে তাদের হৃদয় ভেঙে যাওয়ার কথা শেয়ার করেছেন।বিধ্বস্ত বিমানের পাইলট ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকির ইসলাম সাগরের মৃত্যুতে সামরিক বাহিনীর মধ্যেও শোকের ছায়া নেমে আসে। তৌকিরের ব্যাচমেট থেকে শুরু করে তার স্বজন-পরিচিতজনদের শোকবার্তায় উঠে এসেছে একজন সাহসী ও বিনয়ী ক্যাডেট হিসেবে তার কীর্তির কথা।এই অবস্থায় সোমবার রাত ৯টার দিকে প্রধান উপদেষ্টার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে ভিডিওবার্তা পোস্ট করা হয়। কথা বলার সময় তাকে খুবই বিমর্ষ দেখাচ্ছিল।

ভিডিওবার্তায় প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘‘আমার বলার কোনো ভাষা নেই। কীভাবে শুরু করব সেটাও বুঝতে পারছি না। আমার মতো সারা দেশের লোক আজ হতবাক। এরকম এক কাণ্ড ঘটতে পারে, আমরা কেউ কল্পনা করিনি; কারো ধারণার মধ্যে ছিল না। কিন্তু, এই অবিশ্বাস্য জিনিস আমাদেরকে হঠাৎ করে গ্রহণ করতে হয়েছে।’’তিনি বলেন, ‘‘মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের যে দুর্ঘটনা- প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়ে এই কচি শিশুদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, আগুনে পুড়ে মরল। তাদের মা-বাবাদের আমরা কী জবাব দেব, কী বলব তাদেরকে। আমরা নিজেদেরকেই তো জবাব দিতে পারছি না। অজানা শিশুদের মুখ চোখে ভেসে উঠছে।’’ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘‘এ ঘটনায় সারা জাতি হতভম্ব, বাকরুদ্ধ। শোকাহত বললে খুব কম বলা হবে। এই দুর্ঘটনার রেশ এখনো কাটেনি। এখনো লাশ আসছে হাসপাতালে, এখনো হাসপাতালে মারা যাচ্ছে। মা-বাবা এখনো খোঁজ নিচ্ছে, আমার সন্তান কোথায়। তাকে আর কোনদিন চেনা যাবে কি না। যাদের লাশ দেখছি, তার মধ্যে আমার সন্তান আছে কি না।’’

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘‘পৃথক করার তো কোনো উপায় নেই। এরা আমাদের সবারই সন্তান। হঠাৎ করে চিরদিনের জন্য চলে গেল। আমরা অবশ্যই তদন্ত করব। কিন্তু, তদন্ত করলে তো আর তারা ফিরে আসবে না। আমরা চিকিৎসার ব্যবস্থা করছি। সবাই ঝাঁপিয়ে পড়েছে। হাসপাতালে মানুষ ছুটে আসছে।’’তিনি বলেন, ‘‘সবার কাছে অনুরোধ করছি, হাসপাতালে কেউ ভিড় করবেন না। যারা আহত তাদের জন্য এটা ভালো না। তাদের শরীরে রোগ প্রতিরোধের শক্তি নেই। কাজেই দূর থেকে তাদের জন্য সবাই দোয়া করেন।’’

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘‘আমরা আহত-নিহতদের মা-বাবা, আত্মীয়স্বজন সবার কাছে আমাদের সহানুভূতি জানাচ্ছি; সান্ত্বনা জানাচ্ছি। আমরা তাদের জন্য শোক দিবস ঘোষণা করেছি। আগামীকাল (মঙ্গলবার) শোক দিবস। আমরা সবাই মিলে তাদের কথা স্মরণ করব। নিহতদের আত্মার শান্তি কামনা করব, রুহের মাগফিরাত কামনা করব। তাদের জন্য দেশের সবাই দোয়া করছি।’’অধ্যাপক ইউনূসের ভিডিওবার্তার প্রতিক্রিয়া পোস্টের নিচে কমেন্টে জানিয়েছেন বহু মানুষ। তাদের মধ্যে এবি জুবায়ের নামে একজন কমেন্টে লিখেছেন, “বিধ্বস্ত হওয়া বিমানটা (F-7) চীনের তৈরি। অনেক পুরনো প্রযুক্তির। ২০০০ সালের পর থেকে চীন আর এই বিমান ব্যবহার করে না। আমাদের বিমান বাহিনী কেন এখনো এই মান্দাতার আমলের বিমান ব্যবহার করে? প্রশিক্ষণ বিমান ওড়ানোর কথা জনবসতি থেকে দূরে নিরাপদ কোনো স্থানে৷ মাইলস্টোনের মতো শহুরে এলাকায় এই বিমান কেন?”আরো কতগুলো প্রশ্ন রেখে তিনি লিখেছেন, “রাষ্ট্রের ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম কই? কুইক রেসপন্স টিম কই? সামরিক খাতের বাজেট অপর্যাপ্ত কেন? তার মধ্যেও দূর্নীতির শেষ নাই! এগুলো নিয়ে কোনো আলাপও নাই! বিমানবাহিনী, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনীর সংস্কার কই?”

আদনান আসিফ নামে একজন ফেসবুক ব্যবহারকারী প্রধান উপদেষ্টার পোস্টের নিচে লিখেছেন, “রাষ্ট্রীয় শোক আমরা বুঝি না, আমরা বুঝি প্রত্যেক আ*হতকে সরকার নিজ অর্থায়নে চিকিৎসা তো করাবেই উপরন্তু ৭২ ঘণ্টার মধ্যে যদি সিঙ্গাপুর পাঠানো লাগে সিঙ্গাপুর পাঠাবে, চায়না পাঠানো লাগলে চাইনা পাঠাবে। যা যা করা লাগে সরকার করবে।”তিনি আরো লিখেছেন, “একটা বাচ্চারও যদি গাফলতি, অবহেলা আর যথাযথ চিকিৎসা দিতে দেরির জন্য কিছু হয়, তাহলে খবর ই আছে। আর মাসুম বাচ্ছাগুলোর লাশ নিয়ে রাষ্ট্র নাটক করে কিংবা সংখ্যা লুকানোর চেষ্টা করে তাহলে ছাড় দেওয়া হবে না। আমরা প্রত্যেকটা বাচ্চার হিসেব চাই।”

জাবের আহমেদ নাহিদ নামে একজন লিখেছেন, “শোক বহু দেখেছি স্যার, এগুলো দেখেই বড় হচ্ছি। আপনার নিকট ভিন্ন এক্টিভিটি দেখতে চাই। আপনি সুস্থ তদন্তের ব্যবস্থা করুন, ল্যাংড়া বিমান যে উড়াইতে দিলো তাকে বিচারের আওতায় আনুন।”আহতদের উন্নত চিকিৎসার দাবি রেখে তিনি লেখেন, “উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করুন, বিদেশি মেডিকেল টিম আনুন অথবা আহতদের বিদেশ পাঠান। আমরা চাই না কোনো মায়ের কোল খালি হোক। আমরা চাই না!”

লাবু দেওয়ান নামে একজন ফেসবুক ব্যবহারকারী প্রধান উপদেষ্টার পোস্টের নিচে লিখেছেন, “চারদিকে শুধু মৃত্যুর মিছিল।”

“আজকের দিনটা যেন এক ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন! জানি না, সন্তান হারানো সেই পরিবারগুলো কীভাবে তাদের ছোট ছোট স্বপ্নগুলোকে আগুনে ঝলসে যেতে দেখে বেঁচে থাকবে! তাদের কান্না থামানোর ভাষা আমাদের নেই, কারণ তাদের বেদনার গভীরতা আমাদের কল্পনারও বাইরে। একের পর এক প্রাণহানি আর অজুহাতের দিন শেষ হোক,” লিখেছেন লাবু দেওয়ান।মো. লাভলু মিয়া নামে একজন মন্তব্য করেছেন এভাবে, “এইভাবে দেশের সংস্কার হয় না। আগে দেশের সরকারি অফিস সরকারি কর্মকর্তাদের সংস্কার করেন স্যার। আর কারো মায়ের বুক খালি করবেন না। ১৯৭৪ সালের বিমান দিয়ে প্রশিক্ষণ তাও আবার ঢাকা শহরের মতো জায়গায় পাশে। স্যার আগে সরকারি দপ্তরে সংস্কার করেন। কোটি কোটি টাকা বাজেট যায় কোথায়? এই হিসাব কোন সরকারি অফিস দিতে পারবে বলে আমার মনে হয় না।”

“এই দুর্ঘটনা জবাব কে দিবে? আপনি না বিমানবাহিনী। তারা না জানে না বুঝে না। শুধু এসি রুমে বসে কোটি কোটি টাকার বিলাসিতা চিন্তা মাথায় থাকে তাদের। এই দুর্ঘটনা তদন্ত হোক। কেন এমন বিমান ব্যবহার হলো,” লিখেছেন তিনি।এইচ এম সোহেল নামে একজন লিখেছেন, “সামরিক বাহিনীর দৃশ্যমান কোন উন্নয়ন বা সংস্কার হয় নাই। ১ বছরে বিমান বাহিনীর জন্য কিছুই পাই নাই আমরা। বিমান বাহিনী নিয়ে এন্টায়ার জাতির যে গভীর হাহাকার ও কান্না, তা কারো কানে পৌছে নাই। বিমান বাহিনী একটা জাতির গর্ব। আমাদের গর্বকে সমুন্নত করা হয় নাই।”

“আমাদের শোকের চেয়েও জরুরি দায়ীদের কাঠগড়ায় দাড় করানো। আমরা আর বাচ্চাদের অংগার (পড়ুন অঙ্গার) মৃতদেহ দেখতে চাই না। ঐ সময় আমার সন্তানও আরেক স্কুলে ছিলো,” লিখেছেন তিনি।

প্রধান উপদেষ্টার ভিডিওবার্তাটি পোস্ট করার পর তার নিচে ১ ঘণ্টার মধ্যে প্রায় ১২ হাজার মন্তব্য আসে, যার বেশিরভাগেই বিভিন্ন প্রশ্ন রেখে জবাব চাওয়া হয়েছে সরকারের কাছে।আহত ২৫ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক
সোমবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে সাংবাদিকদের উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী সায়েদুর রহমান বলেন, বিমান বিধ্বস্ত হয়ে আহতদের মধ্যে প্রাথমিক মূল্যায়নে ২৫ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। এখন পর্যন্ত ৮৮ জন হাসপাতালে ভর্তি আছেন।আহতদের বিনা মূল্যে চিকিৎসা দেওয়ার নির্দেশ
বিমান বিধ্বস্ত হয়ে আহতদের বিনা মূল্যে চিকিৎসা দেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা নুরজাহান বেগম। বাসস জানায়, সরকারি হাসপাতাল ছাড়াও সব বেসরকারি হাসপাতালে সম্পূর্ণ বিনা মূল্যে চিকিৎসা সেবা দেওয়ার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। যে কোনো ধরনের অপারগতায় রোগীকে জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউট অথবা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানোর জন্যও পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।বিধ্বস্ত বিমানটি চীনে তৈরি
মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ভবনে বিধ্বস্ত প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমানটি চীনে তৈরি।

আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) আজ সোমবার বিমান বিধ্বস্তের পর জানিয়েছে, বিমানটির মডেল ছিল এফটি-৭ বিজিআই। এটি বেলা ১টা ৬ মিনিটে ঢাকার কুর্মিটোলার বাংলাদেশ বিমানবাহিনী ঘাঁটি এ কে খন্দকার থেকে উড্ডয়নের পর যান্ত্রিক ত্রুটির সম্মুখীন হয়।

সামরিক সরঞ্জাম-সংক্রান্ত যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ওয়েবসাইট গ্লোবাল সিকিউরিটিডটকমের তথ্য অনুযায়ী, এফটি-৭ বিজিআই মডেলের বিমানের নির্মাতা প্রতিষ্ঠান চীনের চেংদু এয়ারক্রাফট করপোরেশন। এটি স্বল্প খরচে নির্মিত, এক ইঞ্জিনচালিত ও দুই আসনবিশিষ্ট একটি প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান। মূল সংস্করণ এফ-৭ এর জন্য পাইলটদের প্রস্তুত করতে এফটি-৭ বিজিআইয়েরমাধ্যমে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।

আরও খবর

                   

জনপ্রিয় সংবাদ