অন্যান্য

সাংবাদিক সুরক্ষা আইন প্রণয়নের  সুপারিশ করেছে সংস্কার কমিশন 

  প্রতিনিধি 22 March 2025 , 3:33:52 প্রিন্ট সংস্করণ

জেমস আব্দুর রহিম রানা:
‘সাংবাদিকদের চাকরি স্থায়ী হলে শুরুর বেতন হবে গেজেটেড কর্মকর্তার মূল বেতনের সমান’
অবশেষে সাংবাদিক সুরক্ষা আইন প্রণয়নের সুপারিশ করেছে সংস্কার কমিশন। শনিবার এক ব্রিফিংয়ের মাধ্যমে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনে কমিশন নেতৃবৃন্দ সাংবাদিক সুরক্ষা আইন সহ বেশ কয়েকটি সুপারিশ করেন।
 গণমাধ্যমকে স্বাধীন, শক্তিশালী ও বস্তুনিষ্ঠ করার লক্ষ্যে সাংবাদিকদের আর্থিক নিরাপত্তা দিতে নবম গ্রেডে বেতন দেওয়ার প্রস্তাব করেছে গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন।
শনিবার প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের হাতে গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পর সংবাদ ব্রিফিংয়ে এ কথা বলেন কমিশনের প্রধান জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক কামাল আহমেদ।
সাংবাদিকদের বেতন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সাংবাদিকদের আর্থিক নিরাপত্তা দিতে হবে। এটি না দেওয়ার ফলে অনেকে অনৈতিক কাজে জড়াচ্ছে। তবে বেতন-ভাতার ওয়েজবোর্ডে আমাদের এখতিয়ার না থাকলেও আর্থিক নিরাপত্তার কথা বলা হয়েছে। ন্যূনতম নবম গ্রেড অনুযায়ী একজন সাংবাদিকের বেতন হতে হবে। পাশাপাশি রাজধানীতে কর্মরত সাংবাদিকদের ঢাকা ভাতা দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, বিসিএস ক্যাডারদের এন্ট্রি ৯ম গ্রেডের যে বেতন, সাংবাদিকতা শুরুর বেতন তার সঙ্গে মিল রেখে যেন করা হয় প্রতিবেদনে সেই সুপারিশ করা হয়েছে।
কামাল আহমেদ বলেন, এটা সারা দেশেই নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া ঢাকায় এর পাশাপাশি ‘ঢাকা ভাতা’ দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। সাংবাদিকতা করতে হলে ন্যূনতম স্নাতক পাসের যোগ্যতা থাকতে হবে। প্রথমে ‘শিক্ষানবিশ সাংবাদিক’ হিসেবে কাজ করতে হবে। শিক্ষানবিশ হিসেবে এক বছর কাজ করতে হবে। এরপর প্রমোশন পাবে।
এছাড়াও কমিশন প্রধান বলেন, সাংবাদিকদের নিরাপত্তা দিতে সাংবাদিকতা সুরক্ষা আইন তৈরির সুপারিশ দেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে সেই আইনের খসড়াও তৈরি করে দেয়া হয়েছে।
একজন ব্যক্তি একটিমাত্র গণমাধ্যমের মালিক হতে পারবেন এমন প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে বলেও জানান গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রধান।
এছাড়া ওয়ান হাউস ওয়ান মিডিয়ার প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বেতারকে স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে। দুটি প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে জাতীয় সম্প্রচার সংস্থা তৈরি করতে হবে। এই সংস্থাকে স্বায়ত্তশাসনের মাধ্যমে পরিচালনা করতে হবে। এর বাইরে অনলাইন পোর্টালের জন্য ৭ দফা সুপারিশ করেছে কমিশন। অনলাইন পোর্টালের জন্য গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের ৭ সুপারিশ করা হয়েছে বলে জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২২ মার্চ দুপুরে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন। প্রতিবেদনে সাংবাদিকদের আর্থিক নিরাপত্তা ও শ্রম আইন সম্পর্কিত সুপারিশে এমন প্রস্তাব করা হয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের জমা দেয়া প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সারা দেশের সাংবাদিকদের স্থায়ী চাকরির শুরুতে একটি অভিন্ন ন্যূনতম বেতন নির্ধারণ করা প্রয়োজন। গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন বলছে, ‘যা হবে সরকারি প্রথম শ্রেণির গেজেটেড কর্মকর্তার মূল বেতনের সমান।’
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গণমাধ্যমের সংখ্যাধিক্য ও দেশের ক্রমবর্ধমান শিক্ষিত বেকারত্বের পটভূমিতে সাংবাদিকতা পেশায় বেতন-ভাতা ক্রমেই কমছে বা অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের প্রবণতা বাড়ছে, যেখানে প্রাপ্য বিভিন্ন ভাতা বাদ পড়ছে এবং চাকরির স্থায়িত্ব অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে। অথচ জীবন-জীবিকার নিশ্চয়তা ছাড়া সাংবাদিকতায় আপসকামিতা ও দুর্নীতির ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়, যা বস্তুনিষ্ঠ ও স্বাধীন সাংবাদিকতার পরিপন্থি। এ ধরনের অনিশ্চয়তা রাজনৈতিক ও স্বার্থবাদী গোষ্ঠীগুলোর প্রতি তোষণবাদী হতে উৎসাহিত বা বাধ্য করে।
এ পরিস্থিতির অবসানে সব সংবাদপত্র, টেলিভিশন চ্যানেল, বেতার ও অনলাইনমাধ্যমের সাংবাদিক ও অন্য সংবাদকর্মীদের জন্য যেসব পদক্ষেপ আবশ্যক—
১. কোনও গণমাধ্যম নিয়োগপত্র ও ছবিসহ পরিচয়পত্র ছাড়া এবং বিনা বেতনে কোনও সাংবাদিককে অস্থায়ী, স্থায়ী কিংবা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ করতে পারবে না।
২. সাংবাদিকদের শিক্ষানবিশ চাকরির মেয়াদ এক বছরের অধিক হবে না। এক্ষেত্রে তাকে সম্মানজনক শিক্ষানবিশ ভাতা প্রধান করতে হবে।
৩. সারা দেশের সাংবাদিকদের স্থায়ী চাকরির শুরুতে একটি অভিন্ন ন্যূনতম বেতন নির্ধারণ করা প্রয়োজন, যা হবে সরকারি প্রথম শ্রেণির গেজেটেড কর্মকর্তার মূল বেতনের সমান। ঢাকায় জীবনযাত্রার ব্যয় অত্যধিক বেশি হওয়ার দরুন ঢাকায় নিয়োজিত সাংবাদিকরা মূল বেতনের সঙ্গে ‘ঢাকা ভাতা’ (অ্যালাউন্স) প্রাপ্য হবেন। তিন বছর সংবাদদাতা (রিটেইনার) হিসেবে কাজ করার পর ঢাকার বাইরের সাংবাদিকরা নিজস্ব প্রতিবেদক (স্টাফ করেসপনডেন্ট) হিসেবে পদোন্নতি লাভ করবেন। ঢাকার বাইরের সাংবাদিকদের বেতন-ভাতা ও মর্যাদার এই বৈষম্য দূর করার প্রয়োজনীয়তার কথা প্রথম প্রেস কমিশন রিপোর্টেও বলা আছে।
৪. মূল বেতনের বাইরে সাংবাদিকরা বাড়ি ভাড়া, যাতায়াত ভাতা, চিকিৎসা ভাতা, মূল বেতনের সমপরিমাণ উৎসব ভাতা, ঝুঁকি ভাতা (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে), ফোন বিল, ইন্টারনেট বিল, প্রভিডেন্ট ফান্ড এবং অবসর ভাতা কিংবা গ্র্যাচুইটি প্রাপ্য হবেন ।
৫. প্রতিবছরের শুরুতে পূর্ব বছরের গড় মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সাংবাদিকদের বেতন বৃদ্ধি হবে। অন্যান্য ভাতার ক্ষেত্রেও অন্তত দুই বছর পরপর মূল্যস্ফীতি সামঞ্জস্য করে পুনর্নির্ধারণ করতে হবে।
৬. ক্যাম্পাস সাংবাদিকদের জন্য আলাদা একটি নিয়োগ বিধি এবং একটি ন্যূনতম বেতন নির্ধারণ করতে হবে। অর্থাৎ বিনা পারিশ্রমিকে কাউকে কাজ করানো যাবে না।
৭. কোনো গণমাধ্যমে সাংবাদিককে সার্কুলেশন তদারকি এবং বিজ্ঞাপন সংগ্রহের কাজে নিয়োজিত করা যাবে না।
৮. কর্মক্ষেত্রে সাংবাদিক এবং গণমাধ্যমকর্মীদের নিরাপত্তা এবং অধিকার নিশ্চিত করার জন্য নিউজপেপার এমপ্লয়িজ (কন্ডিশনস অব সার্ভিসেস অ্যাক্ট) ১৯৭৩ এবং শ্রম আইনের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করতে হবে।
৯. গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান আলোকচিত্রী বা ভিডিও সাংবাদিকদের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম সরবরাহ করবে।
১০. গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান সব সাংবাদিকের প্রযোজ্য ক্ষেত্রে নিরাপত্তাসামগ্রী ও প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করবে। পেশাগত কারণে যেকোনও মামলা-মোকদ্দমা নিরসনের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের আইনি সহায়তা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা নিশ্চিত করতে হবে ।
১১. গণমাধ্যমের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা (সাংবাদিক নন) বর্তমানে যে হারে বেতন-ভাতা প্রাপ্ত হন, তা সাংবাদিকদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধির সঙ্গে সমানুপাতিক হারে (রেশিও অনুসারে) বৃদ্ধি পাবে।
প্রসঙ্গত, গণমাধ্যমকে স্বাধীন, শক্তিশালী ও বস্তুনিষ্ঠ করার লক্ষ্যে গত ১৮ নভেম্বর সরকার ১১ সদস্যের গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন গঠনের প্রজ্ঞাপন জারি করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। কমিশনের প্রধান করা হয় জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক কামাল আহমেদকে।
এদিকে গণমাধ্যম কমিশনের যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত সমুহের প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ মফস্বল সাংবাদিক ফোরাম। শনিবার সংগঠনটির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান আহমেদ আবু জাফর গণমাধ্যম কমিশনকে সাংবাদিকদের তালিকা ও নিয়োগ নীতিমালা প্রণয়নের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন, সাংবাদিকদের তালিকা ও নিয়োগ নীতিমালা না থাকায় কথায় কথায় সাংবাদিক ছাঁটাই, হয়রানির ঘটছে। এছাড়া ঈদ এবং পুজোয় সাংবাদিকদের রাষ্ট্রীয় ভাবে উৎসব ভাতা প্রদানসহ গণমাধ্যম শিল্পকে বাঁচাতে সরকারের দায়িত্বশীল ভুমিকা পালন করা উচিত।

Author

আরও খবর

                   

জনপ্রিয় সংবাদ