অন্যান্য

সুন্দরগঞ্জের পাড়াসাদুয়া তিস্তাগর্ভে বিলীন বিদ্যালয়ের পাঠদান খোলা আকাশের নিচে

  প্রতিনিধি 22 December 2024 , 7:27:33 প্রিন্ট সংস্করণ

 

কামরুল হাসান সুন্দরগঞ্জ (গাইবান্ধা) প্রতিনিধিঃ

 

গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার পাড়াসাদুয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় বার বার তিস্তাগর্ভে বিলীন হওয়ায় বর্তমানে কার্যক্রম চলছে খোলা আকাশের নিচে। দেড়যুগ ধরে বিদ্যায়লটিতে নেই প্রধান শিক্ষক।

 

স্থানীয়রা জানান, তিস্তানদী ভাঙ্গণের ফলে প্রতিবার এক চর থেকে আরেক চরে গৃহ-অপসারণের মাধ্যমে চলে বিদ্যালয়ের কার্যক্রম। চলতি বছর বর্ষায় নদীগর্ভে বিলীন হয় সমস্ত জায়গা-জমি, চরডিজাইন গৃহ, চেয়ার, টেবিল, টিন, ইট, কাঁঠসহ সমস্ত কিছুই। এর ফলশ্রুতিতে ৭ম বারের মত বিদ্যালয় গৃহ সরিয়ে নেয়া হয় অন্যত্রে। এ বছর দীর্ঘ সময় ধরে তিস্তানদীর তীব্র ভাঙ্গণ চলতে থাকে। পানির খরস্রোতে নদীগর্ভে বিলীন হয় পাড়াসাদুয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ আশপাশের পাড়া-গ্রাম, রাস্তা-ঘাট, মানুষের বাস্তুভূমি, আবাদি জমি ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান স্মরণকালের নদীভাঙ্গণে এ প্রাথমিক বিদ্যালয়গৃহ ছাড়াও ঐ চরের সবকিছুই নদীগর্ভে বিলীন হতে থাকলে স্থানীয়দেরকে সঙ্গে নিয়ে নদীর সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে যান বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সাবেক সভাপতি আশাদুজ্জামান সরকার আসাদ নামে এক যুবক।

 

দীর্ঘ প্রচেষ্টায় বিদ্যালয়ের সামান্যতম চেয়ার-টেবিল, বেঞ্চ, ঢেউটিন রক্ষা করতে সক্ষম হন। তিনি অবিরাম প্রচেষ্টায় বিদ্যালয়ের অস্তিত্ব রক্ষার্থে নিজে থেকে টাকা-পয়সা খরচ করেন। এরপর বন্যা ও নদীভাঙ্গণের কারণে বিদ্যালয় কার্যক্রম বন্ধ থাকায় সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কেউই কোন খোঁজ-খবর নিতে পারেননি। প্রতিষ্ঠানের জন্য আপদকালের কোন রবাদ্দ না থাকলেও বিদ্যালয়ের কিছু মালামাল রক্ষা করে দ্রুতগতিতে অন্যত্রে সরিয়ে নিতে জায়গা-জমি নির্ধারণ, মাটি ভরাট (উঁচু), কাঁঠ, টিনসহ নির্মাণ সামগ্রী ও শ্রমিকদের জন্য অর্থ খরচের মাধ্যমে গৃহ-নির্মাণ করে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের পাঠদানের ব্যবস্থা চালু করতে মরিয়া হয়ে ওঠেন যুবক আসাদ। তিনি গৃহ-নির্মাণ কাজ চালাতে থাকলেও শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ থাকতে দেননি। জমিতে মসজিদ নির্মাণ করে ঐ মসজিদের বেড়ার পাশে খোলা আকাশের নিচেই পাঠদানের জন্য শিক্ষকদেরকে দায় চাপিয়ে থাকেন। আর সেখানেই চলছে বিদ্যালয়ের কার্যক্রম। যা, নিঃসন্দেহেই প্রশংসনীয় পদক্ষেপ।

১৯৭৩ সালে বিদ্যালয়টি জাতীয় করণের আগে এলাকায় প্রাথমিক শিক্ষা প্রসারে তৎকালীণ সচেতন ব্যক্তিবর্গকে সঙ্গে নিয়ে আশাদুজ্জামান আসাদের পূর্ব-পুরুষ প্রতিষ্ঠি করেন পাড়াসাদুয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি। তখন থেকে বিদ্যালয়গৃহ ও জায়গাজমি বার বার নদীগর্ভে বিলীন হয়। প্রতিবছর বন্যায় নদীর গতিপথ বদলে যাওয়ায় নতুন নতুন চরে বিদ্যালয়টি স্থানান্তরিত করা হয়ে থাকে। এরজন্য বাড়তি কোন বরাদ্দ না থাকায় স্থানীয়ভাবে পূর্ব-পুরুষের মতই দায় বহণ করে যাচ্ছেন শিক্ষানুরাগী ও সুশীল সমাজ বিনির্মাণে প্রত্যয়ী যুবক আশাদুজ্জামান আসাদ।

গত সোমবার বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মোস্তাফিজুর রহমান জানান, নদ-নদী বেষ্টিত এ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক বদলী আসতে চায়না। তাই, দীর্ঘ দেড়যুগ থেকে প্রধান শিক্ষক হিসেবে কেউই নেই। ২০০৬ সালে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হাসান আলী অবসর গ্রহণ করলে পদটি শূন্য হয়। বর্তমানে তিনিসহ মোট ৩ জন শিক্ষক নিয়োজিত আছেন। অপর ২ জন হলেন, অজিফা খাতুন ও মহসিনা খাতুন। তিনি আরও জানান, সম্প্রতি অপসারিত এসএমসি’র সভাপতি আসাদ বিদ্যালয়ের নামে জায়গা-জমির ব্যবস্থা করেন।এছাড়া, সাড়ে ৩ লাখেরও বেশি পরিমাণ টাকা ব্যয় করে ঐ জমিতে মাটি ভরাট, বারান্দাসহ গৃহ-নির্মাণ করছেন। নব্য নির্মিত গৃহে কোন মতে হলেও বিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট কাজ চালাতে আরও কয়েকদিন সময় লাগবে।

আশাদুজ্জামান আসাদ জানান, তিনি ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি থাকায় চলতি বছরের গত ২০ জুলাই দেশব্যাপী সকল প্রতিষ্ঠানের সভাপতি অপসারণের পর ক্লাষ্টারে দায়িত্বপ্রাপ্ত সহকারী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা রিপন আলী পদাধিকার বলে সভাপতির দায়িত্বে রয়েছেন। ১৯৭৩ সালে জাতীয় করণের পূর্বে বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেন ওসমান আলী খন্দকার। ব্রহ্মপুত্র-তিস্তার মত নদ-নদী বেষ্টিত এ স্থানে সমাজসেবক সোলায়মান হাজারী ছাড়াও ফজল হক মুন্সী এ বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি ছিলেন। অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে বর্তমানে চরাঞ্চলে প্রাথমিক শিক্ষার গুরুত্ব দিনে দিনে অনেক গুণে বেড়েই চলছে। সমাজসেবক আসাদের জানামতে গত বর্ষায় সর্বশেষ ৭ম বারের মত বিদ্যালয়ের সর্বস্ব করালগ্রাসি তিস্তাগর্ভে চলে যায়।

সহকারি উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা রিপন আলী জানান, দুর্গম এলাকায় স্থাপিত বিদ্যালয়টিতে মোট ৩ জন শিক্ষক নিয়োজিত। দেড়যুগ থেকে প্রধান শিক্ষক না থাকায় একজন ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হিসেবে আছেন। গত বন্যায় বিদ্যালয়টির সর্বস্ব নদীগর্ভে বিলীন হয়। নদীভাঙ্গণ কবলে বিদ্যালয়ের অবকাঠামো রক্ষার্থে, দ্রুত স্থানান্তরিতসহ বিদ্যালয় কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে কোন বরাদ্দ নেই। তবে, চাহিদা পাঠানো হয়েছে। বন্যায় নদীভাঙ্গণে চলে যাবার সময় স্থানীয়ভাবে রক্ষা করাসহ পূণঃ গৃহ-নির্মাণে যে টাকা খরচ হয়েছে, তা স্থানীয়রা প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে ব্যয় করেছেন। উপর থেকে কোন বরাদ্দ পেলে সমন্বয় করা যেতে পারে। বিদ্যালয়টির শিক্ষা কার্যক্রম সন্তোষজনক। সদ্য অপসারিত এসএমসি’র সভাপতি বিদ্যালটির অবকাঠামোগত যেটুকু রক্ষা করেছেন আর ব্যক্তিগতভাবে মাটি ভরাট, জায়গা-জমি, গৃহ-নির্মাণ করে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। আপাতত চর ডিজাইন মোতাবেক গৃহ-নির্মাণ ও পরবর্তীতে পূর্ণরূপে গৃহ-নির্মাণের জন্য বরাদ্দ প্রয়োজন। বিদ্যালয়ের জায়গা-জমিও আসাদ ও তার ওয়ারিশগণ বিদ্যালয়ের নামে লিখে দিয়েছেন। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করে আরো বলেন, আগামী কয়েক দিনের মধ্যে ছাউনি (চালে টিন লাগানো) শেষ হবে।

 

 

উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, নদীভাঙ্গণের কবল থেকে রক্ষা করতে ও পূণঃ প্রতিষ্ঠায় বিদ্যালয়টির জন্য এলকাবাসী যা করেছেন। তা নিঃসন্দেহেই প্রসংশনীয়। বিদ্যালয়ের স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আনতে উচ্চ পর্যায়ে বরাদ্দ চেয়ে চাহিদা সম্পর্কে লেখা হয়েছে।

 

 

জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা নবেজ উদ্দিন সরকার মুঠোফোনে বলেন, আমি নতুন এসেছি, এখনো বিদ্যালয়টিতে যেতে পারিনি। তবে, গত সপ্তাহে এ বিদ্যালয়ের জন্য চাহিদা পাঠানো হয়েছে। বিষয়টি জানতে পেয়ে তিনি আরো বলেন, যতদূর জেনেছি, এলাকাবাসীর প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠানটি টিকে আছে। অপর এক জবাবে তিনি বলেন, নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়া বিদ্যালয়ের প্রয়োজনীয় সবকিছুই বরাদ্দ দেয়ার ব্যাপারে তাঁর পক্ষ থেকে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা থাকবে। তিনি এলাকাবাসীর ভূমিকায় ভূয়শী প্রশংসা করে করেন।

Author

আরও খবর

                   

জনপ্রিয় সংবাদ