উসমানী মঞ্চে স্বীকৃতি, বিটিভিতে স্বপ্ব তবু লোকসঙ্গীতের যোদ্ধা জসীম পারভেজ আজও লড়ছেন টানাপোড়েনের সুরে সেইদিন উসমানী মিলনায়তনের আলোয় দাঁড়িয়ে যখন জাতীয় পুরস্কার হাতে নিই ভাবিনি জীবনে একদিন টাকার অভাবে গান থেমে যেতে বসবে
স্টাফ রিপোর্টার | দৈনিক চেতনায় বাংলাদেশ
বাংলার গ্রামীণ হৃদয়ে জন্ম নেয়া এক ক্ষণজন্মা শিল্পীর নাম জসীম পারভেজ। যশোর জেলার মনিরামপুর থানার খাকুন্দী গ্রামে বেড়ে ওঠা এই সাধকের জীবন শুরু হয়েছিল নিঃস্ব অবস্থায় কিন্তু হৃদয়ে ছিল বিশাল এক মহাসমুদ্র: সংগীত।
১৯৯৮ সালে, পিতার হাতে হাত রেখে পা রাখেন সংগীতের জগতে। ভর্তি হন ১৬ নং ইউনিয়নের পাচাকড়ি কুহুতান সংগীত একাডেমিতে। সেখান থেকেই গানের প্রথম পাঠ শুরু বাবু আশুতোষ স্যারের কাছে। এরপর তালিম নেন মহিতোষ স্যারের, গাজী হুমায়ুন কবীর, সাধন স্যার, এবং সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ গুরু ইসমাইল স্যারের কাছ থেকে।
উসমানী স্মৃতি মিলনায়তনের সেই দিনটা…
২০০০ সাল। জীবনের এক অনন্য প্রাপ্তি। দেশজ লোকসংগীতের প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে পুরস্কার জিতে নেন। ঢাকার বুকে, ঐতিহাসিক উসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে হাতে তুলে দেওয়া হয় সেই সম্মাননা।
মঞ্চ আলোয় ঝলমল, সামনে উপস্থিত দেশের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা, আর মায়ের চোখে অশ্রু এই তিনেই গাঁথা হয়ে আছে জসীমের জীবনের সেরা মুহূর্ত।
বিটিভির ‘লোকসংগীত’-এ তাঁর কণ্ঠে গাওয়া ‘হিজলতমালে’ আজও মানুষের মনে বাজে
জাতীয় স্বীকৃতির পর ডাক আসে বাংলাদেশ টেলিভিশনের (বিটিভি) লোকসংগীত অনুষ্ঠানে। সেদিন তিনি গেয়েছিলেন চিরচেনা সুরে “হিজলতমালে ডাকি, ও মোর মায়ারে দাদা…” বিটিভির সেই পরিবেশনা আজও বহু লোকসংগীতপ্রেমীর হৃদয়ে অমলিন হয়ে আছে। সেদিনের অনুষ্ঠান ছিলো যেন দেশের কোটি মানুষের সামনে নিজেকে তুলে ধরার স্বপ্নপূরণের দিন।
তবু থেমে যায় স্বপ্নের পথে টাকার কাছে হেরে যায় প্রতিভা
গান, স্বীকৃতি, মঞ্চ সব ছিল। কিন্তু যা ছিল না, তা হলো অর্থ।মনিরা খানের সঙ্গে অ্যালবাম রেকর্ডিংয়ের সবকিছু ঠিক থাকলেও শেষ পর্যন্ত ভেঙে যায় সব টাকার অভাবে। কেউ এগিয়ে আসে না। পৃষ্ঠপোষকতা মেলে না। মিডিয়ার দৃষ্টি সরে যায় আলো ঝলমলে স্টুডিওতে, আর গ্রামবাংলার গুণীজনেরা পড়ে থাকেন অবহেলায়।“আমি গান শিখিয়েছি না খেয়ে থেকেও। শুধু ভাবি, কেউ যদি আমার ছাত্রদের একজনকে সামনে নিয়ে যেতে পারতো...”‘ সুরপ্রাণ সংগীত একাডেমি গ্রামের ঘরে জ্বলছে আশার প্রদীপ আজও জসীম পারভেজ থেমে যাননি। গানের শিকড় ধরে রাখার জন্য নিজের এলাকায় শুরু করেছেন ‘সুরপ্রাণ সংগীত একাডেমি’, যেখানে ২০ জনেরও বেশি ছাত্রছাত্রী নিয়মিত গান শেখে। পাশে আছেন সংগীতপ্রেমী সমিরন সরকার। অ্যাকাডেমির প্রতিটি ক্লাস, প্রতিটি সুর যেন তার অস্তিত্বের চিহ্ন লড়াইয়ের প্রতিধ্বনি।তার স্বপ্ন শুধু নিজের নয় বাংলার লোকসঙ্গীতকে পৌঁছে দিতে চান বিশ্বদরবারে
তিনি বলেন
আমি চাই আমার ছাত্রেরা একদিন বিদেশি মঞ্চে লোকগান গাইবে। বলবে, ওস্তাদ ছিলেন জসীম পারভেজ, মনিরামপুরের খাকুন্দী থেকে এসেছেন এই একাডেমিকে তিনি একদিন জাতীয় মানের সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখতে চান। চান সরকারি স্বীকৃতি, মিডিয়া কাভারেজ, স্টুডিও সুবিধা যেন গ্রামের প্রতিভারা শহরের মতো সুযোগ পায়।
আমরা কি হারিয়ে ফেলব এমন একজন শিল্পীকে?
যদি তিনি শহরে জন্মাতেন, যদি পাশে কোনো কর্পোরেট ব্র্যান্ড থাকতো তবে হয়তো আজ তিনি বাংলা একাডেমির মঞ্চে, জাতীয় দিবসের সাংস্কৃতিক আসরে বা আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে পরিচিত মুখ হতেন। কিন্তু দুঃখজনকভাবে তিনি আজও লড়ছেন একা, পরিবার আর ছাত্রদের পাশে নিয়ে।
আমরা জসীম পারভেজের পাশে দাঁড়াবো না?
পক্ষ থেকে আমরা আহ্বান জানাই সরকার, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, কর্পোরেট হাউজ, মিডিয়া ও সংস্কৃতিপ্রেমী মানুষদের প্রতি লোকসংগীতের এই নিঃস্ব স্বপ্নবান যোদ্ধার পাশে দাঁড়ান।একজন জসীম পারভেজ বাঁচলে বেঁচে থাকবে আমাদের মাটি, সুর, লোকগান, আর বাংলার আত্মা।