অন্যান্য

১৬ ডিসেম্বর: বিজয়ের মহাকাব্য ও বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা

  প্রতিনিধি 14 December 2024 , 1:46:51 প্রিন্ট সংস্করণ

 

মুহাঃ আশরাফুল ইসলাম,মনপুরা উপজেলা প্রতিনিধি

 

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর — বাঙালির ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবময় ও চিরস্মরণীয় দিন। এই দিনে পূর্ব পাকিস্তান নামের অস্তিত্বের অবসান ঘটিয়ে বিশ্বের মানচিত্রে আত্মপ্রকাশ করেছিল স্বাধীন বাংলাদেশ। ২৪ বছরের শোষণ, বৈষম্য আর দমন-পীড়নের অবসান ঘটিয়ে একটি স্বাধীন জাতি তার আত্মমর্যাদার অধিকার ফিরে পায়। বিজয়ের এই দিনটি বাঙালির জন্য শুধু একটি তারিখ নয়; এটি আমাদের আত্মত্যাগ, সংগ্রাম আর সাহসিকতার প্রতীক।

মুক্তির পথে দীর্ঘ সংগ্রাম

 

বাংলাদেশের বিজয়ের ইতিহাস নতুন করে শুরু হয়নি। এর ভিত্তি ছিল বহু পুরোনো। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর থেকে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ ধীরে ধীরে উপলব্ধি করেছিল যে, তাদের স্বপ্ন ও অধিকার এখানে পূরণ হচ্ছে না। ভাষা আন্দোলন ছিল বাঙালির আত্মপরিচয়ের প্রথম দৃঢ় প্রকাশ। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে ঢাকার রাজপথে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারদের রক্তে লেখা হয় আমাদের মাতৃভাষার অধিকার।

 

এরপর একের পর এক বঞ্চনা আর বৈষম্যের শিকার হতে হতে বাঙালির ক্ষোভ পরিণত হয় দাবানলে। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফা আন্দোলন ছিল বাঙালির অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক মুক্তির স্পষ্ট রূপরেখা। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয় হলেও পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা হস্তান্তর করতে অস্বীকৃতি জানায়।

 

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী অপারেশন সার্চলাইট নামক বর্বর অভিযানের মাধ্যমে বাঙালির উপর নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালায়। সেই রাতেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। এরপর শুরু হয় এক রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ।

 

বিজয়ের সেই ঐতিহাসিক মুহূর্ত

 

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) দুপুর ৪টা ৩১ মিনিটে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজি যৌথ বাহিনীর কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করেন। উপস্থিত লাখো জনতা তখন উল্লাসে ফেটে পড়ে। বাংলাদেশের বিজয়ের ঘোষণা ছড়িয়ে পড়ে দেশের আনাচে-কানাচে। স্বাধীনতা সংগ্রামের ৯ মাসের ত্যাগ আর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত সেই বিজয় ছিল বাঙালির হাজার বছরের শোষণ-বঞ্চনার অবসানের চূড়ান্ত মুহূর্ত।

 

মুক্তিযুদ্ধে জনসাধারণের অবদান

 

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন লাখো মুক্তিযোদ্ধা। কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, শিক্ষক, নারী, বৃদ্ধ— সকল শ্রেণির মানুষ একসঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল দেশের স্বাধীনতার জন্য। স্বাধীনতার এই সংগ্রামে ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হন, দুই লাখের বেশি মা-বোনের ইজ্জত হরণ করা হয়। লাখো শরণার্থী দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নেয়। মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে সীমান্তের ওপারে গঠিত হয় মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং ক্যাম্প। দেশমাতৃকার জন্য এই আত্মত্যাগের ইতিহাস বিশ্বের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে এক অনন্য নজির।

 

নারীদের অবদানও ছিল অসামান্য। মুক্তিযুদ্ধে নারীরা শুধু সহায়তা করেননি, সরাসরি অস্ত্র হাতে যুদ্ধেও অংশ নিয়েছেন। সেই সাথে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণার প্রধান মাধ্যম।

 

বিজয়ের চেতনা এবং বর্তমান প্রজন্ম

 

স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরও বিজয়ের চেতনা আমাদের জাতীয় জীবনের ভিত্তি হওয়া উচিত। তবে এই চেতনার পূর্ণ বাস্তবায়ন এখনো অনেক দূরে। দুর্নীতি, রাজনৈতিক অস্থিরতা, দারিদ্র্য, বৈষম্য আমাদের অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করছে। বিজয়ের এই দিনে আমাদের আত্মজিজ্ঞাসা করা দরকার — আমরা কি সত্যিই মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়তে পেরেছি?

 

বিজয়ের চেতনাকে বাস্তবে রূপ দিতে হলে সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। স্বাধীনতা শুধু ভূখণ্ডের নয়; এটি সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তিরও দাবি রাখে। বর্তমান প্রজন্মের হাতে এই চেতনার শিখা জ্বালিয়ে রাখতে হবে। প্রযুক্তি, শিক্ষা, সংস্কৃতির উন্নয়নের মাধ্যমে তাদের এগিয়ে যেতে হবে।

 

উপসংহার

 

১৬ ডিসেম্বরের বিজয় শুধু একটি দিনের উৎসব নয়; এটি আমাদের জাতীয় জীবনের চলার পথের আলোকবর্তিকা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রতিফলিত হলে তবেই বিজয়ের প্রকৃত মূল্যায়ন হবে। আসুন, আমরা সবাই মিলে নতুন প্রজন্মের হাত ধরে একটি সোনার বাংলা গড়ে তুলি — যেখানে থাকবে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ, ন্যায়বিচার, সমতা আর শান্তি।

 

১৬ ডিসেম্বরের বিজয়ের পতাকা আমাদের হাতে তুলে দিয়ে গেছে যে দায়িত্ব, তা যেন আমরা কখনোই ভুলে না যাই।

Author

আরও খবর

                   

জনপ্রিয় সংবাদ