বর্ষা মৌসুম শেষ হলেও যশোর-খুলনার দুঃখ হিসেবে পরিচিত ভবদহের পানি নামে না। যশোরের মনিরামপুর, কেশবপুর, অভয়নগর ও খুলনার ডুমুরিয়া, ফুলতলা এলাকার শ্রী, হরি ও টেকা নদীর মোহনাস্থল হলো ভবদহ। পলিমাটি জমে নদীর তলদেশ উঁচু ও ফসলি জমি বিশেষ করে বিলের তলদেশ নিচু হওয়ায় বর্ষা মৌসুমে প্রতিবছরই ভবদহ এলাকা প্লাবিত হয়। পানি নিষ্কাষণ না হওয়ায় প্রায় সারা বছরই জলাবদ্ধতা দেখা দেয় সেখানে। পানিবন্দী হয়ে থাকেন ভবদহ তীরবর্তী ১০০টি গ্রামের ৫ লক্ষাধিক মানুষ। এমনটি হয়ে আসছে গেল ৪৪ বছর ধরে। ভবদহের জলাবদ্ধতা এখন স্থায়ী রূপ নিয়েছে। সারা বছরই খাল-বিলে পানি থৈ থৈ করে। ফলে বেঁচে থাকার তাগিদে ওই এলাকার মানুষ বেছে নিয়েছেন নানান পেশা। ফসল আবাদের পরিবর্তে ঝুঁকে পড়েন মাছ চাষের দিকে। ভবদহের স্থায়ী জলাবদ্ধতার কারণে মানুষের যাতায়াত, লোক পারাপার, বিলে মাছ ধরা, মাছের খামারে খাবার নেওয়াসহ নানা কাজের একমাত্র অবলম্বন হলো ছোট নৌকা। স্থানীয় ভাষায় যাকে বলা হয় ‘ডোঙা’। ভবদহ অঞ্চলের নিত্যদিনের প্রয়োজনীয় এই ডিঙি নৌকা তৈরির জন্যও গড়ে উঠেছে কারখানা। মনিরামপুরের কুমারঘাটা,মনোহরপুরে বাজারে নৌকা তৈরির কারখানায় ব্যস্ত সময় পার করেন কারিগররা। সরেজমিনে দেখা যায়, কুমারঘাটা বাজারে ২২-২৩ টি নৌকা তৈরির ঘর রয়েছে। যেখানে ব্যস্ত সময় পার করছেন শতাধিক শ্রমিক। এই বাজার ছাড়াও উপজেলার মনোহরপুর, কপালিয়া, কালিবাড়ি, নেহালপুর, বাহাদুরপুর ,মনোহরপুরও কোনাকোলা এলাকায় চলে ছোট নৌকা তৈরির কাজ। মনিরামপুর উপজেলার বিভিন্ন এলাকাসহ সাতক্ষীরা, বেনাপোল, বটিয়াঘাটা, কেশবপুর, ডুমুরিয়া, অভয়নগর, নড়াইল এলাকায় বিক্রি হয় এসব নৌকা। ক্রেতারা এসে ৬-১২ হাজার টাকায় কেনেন ছোট আকারের এসব নৌকা। পেরেক এবং মেহগনি, পুইয়ে, লম্বু ও খই কাঠে তৈরি হয় নৌকা। তিনজন শ্রমিক দিনে একটি করে নৌকা তৈরি করেন। কাজ শেষে বৈদ্যুতিক মেশিনে পালিশ করে রোদে শুকিয়ে কালো রং করা হয় নৌকায়। নৌকার কারিগর স্থানীয় কুমারঘাটা গ্রামের ইনতাজ আলী ও মো দেলোয়ার বলেন, ‘ডোঙা তৈরির কাজ করি ৪৫ বছর। এ কাজ করে ৮ জন মানুষের সংসার চালাতি অনেক কষ্ট হয়।’ নৌকার কারিগর কপালিয়া গ্রামের কার্তিক মন্ডল বলেন, ‘বংশ পরস্পরায় নৌকা তৈরির কাজ করছি আজ ৪০ বছর ধরে। প্রথম দিকে বাড়ি বাড়ি গিয়ে কাজ করতাম। ৩০ বছর ধরে কুমারঘাটা বাজারে কাজ করছি। একটা ছেলে তাকেও শিখাইছি। ১০ টাকা থেকে শুরু করে এখন ৭০০ টাকা মজুরি পাই। সারা বছর কাজ চলে। বসে থাকা লাগে না।’ খুলনার কয়রা উপজেলা থেকে কুমারঘাটা বাজারে নৌকা তৈরির কাজ করতে এসেছেন মুজিবর রহমান। তিনি বলেন, ‘তিনজনে মিলে দিনে একটা ডোঙা (নৌকা) তৈরি করি। এক হাজার টাকা থেকে ৮০০ টাকা হাজিরা পাই। শ্রমিকদের অধিকাংশ বংশ পরস্পরায় এ কাজের সাথে জড়িত।’ মোশতাক আহমেদ নামে আরেকজন বলেন, ‘ভবদহ জলাবদ্ধতার কারণে এ অঞ্চলের মানুষের নৌকা ছাড়া কোন উপায় থাকে না। সেই চাহিদা থেকে নৌকা তৈরির কাজ শুরু করি। তাছাড়া ডোবা এলাকা। ফসল তেমন হয় না। সারা বছর খাল বিলে পানি থাকে এসব এলাকায় নৌকার প্রয়োজন সারা বছরই। নৌকা তৈরির প্রয়োজনীয় উপকরণের দাম বেশি। লাভ হয় কম। তারপরও পেশাটাকে ধরে রেখেছি।’ মনিরামপুর উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মো. রোকনুজ্জামান বলেন, ‘ভবদহের স্থায়ী জলাবদ্ধতার কারণে মানুষের নিত্য প্রয়োজনের তাগিদে নৌকার কারখানা গড়ে উঠেছে। ওই সকল কাজে নিয়োজিতদের এই দপ্তরের পক্ষ থেকে সুযোগ থাকলে সহযোগিতা দেওয়া হবে।’ উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা মোঃ রেজাউল হক বলেন, ‘নৌকা তৈরির সাথে সংশ্লিষ্টদের যুব প্রশিক্ষণ ও যুব ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা করা হবে।