দুর্গাপুর (নেত্রকোনা) প্রতিনিধিঃ
প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যে ঘেরা নেত্রকোনা জেলার সীমান্তবর্তী পাহাড়ি উপজেলা দুর্গাপুর। পাহাড়ে ঘেরা এই জনপদে যুগ যুগ ধরে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের পাশাপাশি বসবাস করে আসছে বাঙালিরা। তবে দীর্ঘদিন ধরেই তারা ভুগছেন সুপেয় পানির সংকটে।
দুর্গাপুর উপজেলার একেবারেই সীমান্ত ঘেঁষা প্রায় প্রতিটি গ্রামেই থাকে বিশুদ্ধ পানির সংকট। বিশেষ করে নভেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত শুষ্ক মৌসুমে এসব এলাকার অগভীর নলকূপে পানি একেবারেই মেলে না। তাই দৈনন্দিন কাজ সহ সকল কাজের জন্যই পানি সংগ্রহের একমাত্র ভরসা পাহাড়ি ঝর্ণা ছড়া ও খাল গুলো।
স্থানীয়রা বলছেন পাহাড়ি সীমান্ত এলাকার মাটির ভূগর্ভস্থলে পাথর থাকায় গভীর নলকূপ কিংবা মোটর স্থাপন অনেক ব্যয়বহুল। স্থানীয়ভাবে রিং টিউবওয়েল স্থাপন করলেও শুকনো মৌসুমে আয়রনের কারণে সেগুলোর পানিও পানের অযোগ্য হয়ে যায়। তাই সরকারিভাবে দীর্ঘদিন ধরেই পাহাড়ি গ্রামগুলোতে গভীর নলকূপ স্থাপনের দাবি জানিয়ে আসলেও দীর্ঘদিনেও তা বাস্তবায়ন হয়নি বলে দিন দিন বাড়ছে সীমান্ত এলাকার মানুষের দুর্ভোগ।
দুর্গাপুর উপজেলা সিমান্ত ঘেসা বাদামবাড়ী গ্রামের বৃদ্ধা লেমিতা তাজেল পানি সংগ্রহের এই কষ্ট প্রায় ৪৮ বছরের। ভারত সিমান্ত পিলার এর ধারে ছোট একটি গর্তে পাহাড় থেকে চুঁয়ে আসা পানি জমা হয়, যা তার বাড়ি থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দুর, সেখান থেকেই প্রতিদিন কয়েকবার পানি সংগ্রহ করেন তিনি । বয়সের ভারে শরীর সাই না দিলেও পানি সংগ্রহে যেতেই হয়,দুরে সিমান্তের অনিরাপদ স্থানে।
তিনি জানান, দীর্ঘদিন ধরে এই পানির জন্য আমাদের কষ্ট। বিশেষ করে পাহাড়ে দুরত্বের কারণে। তবুও আমাদের কি করা কষ্ট করে হলেও খাইতে হবে তো। আমাদের পানি না থাকার কারণে আমরা পাহাড় চুঁয়ে জমা হওয়া পনিই এক কিলোমিটার দুর থেকে এনে পান করি। আমাদের এলাকায় বর্ষাকালে পানি সহজে পাওয়া গেল শুকনো মৌসুমের পানি একেবারেই পাওয়া যায় না।
এদিকে পার্শ্ববর্তী ডাহাপাড়া গ্রামের মোছাঃ জোসনা আক্তার বলেন, সংসারের দৈনন্দিন কাজের পাশাপাশি পানি সংগ্রহ করতে হয় পাহাড়ের নিচ থেকে। পাহাড়ের পাশে ছোট ইন্দারা করে সংগ্রহ করেন খাবারের পানি। যা অস্বাস্থ্যকর, বিভিন্ন পাখি ও প্রাণীদের মল মিশে থাকতে দেখা যায় এই পানিতে। এই পানি পান করে শিশু সহ বয়স্কদের সারা বছরই ভুগতে হয় নানান পানিবাহিত রোগে। তবুও বাধ্য হয়েই এই পানি পান করতে হয় প্রতিদিন।
গোপালপুর গ্রামের স্কুল শিক্ষার্থী তৃষ্ণা নকরেক জানান, শুষ্ক মৌসুমে আমাদের পানির জন্য অনেক কষ্ট করতে হয়। পানি যেহেতু আমাদের খেতে হয় তাই যত দূরে বা পাহাড়ের নিচে হোক আমাদের পানি আনতেই হবে। আমার জন্মের পর থেকেই কষ্ট করে পানি আনতে দেখেছি এখন আমরাও আনি। সরকারের কাছে আমরা আবেদন জানাই যাতে পাহাড়ে বসবাস কারী আমাদের জন্য বিশুদ্ধ ও সহজে পানি পাওয়ার একটু ব্যবস্থা করে দেয়। আমরা যদি একটু সুবিধা পাই তাহলে আমাদের কষ্ট অনেকটাই কমবে।
বাংলাদেশ জাতীয় হাজং সংগঠনের সভাপতি পল্টন হাজং জানান, সীমন্ত প্রতি পাহাড়ি এলাকায় খাবার পানির সংকট দীর্ঘদিন ধরেই। ঝর্না ছড়ার পানি তাদের খাবার একমাত্র উৎস। মূলত এগুলো অস্বাস্থ্যকর পিউরিফাই না। যার কারনে টাইফয়েড সহ পানিবাহিত বিভিন্ন রোগ হয়ে থাকে। এসব গ্রামে সরকারি উদ্যোগে এখনো কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। পাহাড়ে যদি সরকারি ভাবে গভীর নলকূপ বসানো হতো এবং সুপেয় পানির একটা ব্যবস্থা করা যেত তাহলে এই অঞ্চলের মানুষের অনেকটাই সুবিধা হত। এ ব্যাপারে বিভিন্ন সময় উদ্যোগ নেওয়া হলেও এখন পর্যন্ত কোন কাজ হয়নি। পাহাড়ে গারো-হাজং সহ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সংখ্যাই বেশি। তবে এইসব পাহাড়ি অঞ্চলের প্রধান সমস্যাই হচ্ছে বিশুদ্ধ পানির সংকট। আমরা সরকারের কাছে বিনীতভাবে অনুরোধ জানাচ্ছি যেন দ্রুতই পাহাড়ি অঞ্চলগুলোতে সুপেয় পানির ব্যবস্থা করা হয়।
জেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ মশিউর রহমান জানান, পাহাড়ি অঞ্চলের জন্য বিশেষ কোনো বরাদ্দ এখনো আসেনি সাধারণ যে বরাদ্দগুলো রয়েছে, বিশেষ করে স্থানীয় জন প্রতিনিধিরা যেভাবে প্রয়োজন মনে করেছেন সেইসকল স্থানের তালিকা দিয়েছেন আমরা ওইভাবে বাস্তবায়ন করে দিয়েছি। তবে পাহাড়ী অঞ্চলে একটি প্রকল্প আমরা প্রস্তাব করেছিলাম। প্রকল্পটি এখনো প্রক্রিয়াধীন রয়েছে তবে এটি বাস্তবায়ন হলে পাহাড়ি অঞ্চলের সুপেয় পানির সমস্যা নিরসনে হবে।
এ প্রকল্পের মধ্যে যে পাহাড়ে মাটির গভীরে পাথর রয়েছে তার জন্য ডায়মন্ড কাটার ব্যবহার করে গভীর নলকূপ উপস্থাপন। সেক্ষেত্রে যদি বিশেষ দর নির্ণয় করতে হয় তার জন্যও আমরা প্রস্তাবনা পূরণ করেছি। এছাড়াও বৃষ্টির পানি ধরে রাখা ও প্রাকৃতিক জলাশয় বা পাহাড়ি ঝর্ণা ছড়ার পানিও কিভাবে ধরে রেখে সমস্যা নিরসন করা যায় তাও প্রকল্পে প্রস্তাব আকারে উপস্থাপনা করা হয়েছে।
আনিসুল হক সুমন
দুর্গাপুর (নেত্রকোনা) প্রতিনিধি,২২/০৩/২০২৫ইং