অন্যান্য

জীবন সংগ্রামে ক্লান্ত গ্রাম পুলিশ, জাতীয়করণ কি দেবে মুক্তি? 

  প্রতিনিধি 17 April 2025 , 12:51:17 প্রিন্ট সংস্করণ

মাহতিম আহমেদ রাজা

আমরা নামেই ‘গ্রামপুলিশ’। থানা পুলিশের ‘আই পাওয়ার’ হিসেবেও আমরা কাজ করি। রাত-দিন গ্রামের সুরক্ষায় নিরলস প্রহরীর কাজ করি। ইউনিয়ন পরিষদেও যথেষ্ট সময় দিতে হয়। বলতে গেলে অনেক সময় রাত-দিন চব্বিশ ঘণ্টা কাজ করতে হয়। অথচ আমরা যা বেতন পাই তা দিয়ে লবণ-ভাত খাওয়াও কঠিন হয়ে পড়েছে। সন্তানদের ভালো স্কুলে লেখাপড়া করানো কিংবা সংসারের সাধারণ চাহিদাগুলোও পূরণ করতে পারি না।

 

তখন নিজেকে ব্যর্থ বাবা বা অভিভাবক মনে হয়। সবখানে উন্নয়ন হয়, সবার বেতন বাড়ে, ভাগ্যেরও উন্নয়ন হয়; কিন্তু আমরা সেই অবহেলার মধ্যেই পড়ে আছি।’ বুকচাপা কষ্ট নিয়ে মর্নিং পোস্টকে এসব কথা বলেছেন যশোরের মনিরামপুর উপজেলার ১৭ নং মনোহরপুর ইউনিয়নের দফাদার বাবু জয়দেব বিশ্বাস

 

৭ নং ওয়ার্ডের গ্রাম পুলিশ মোঃ মাসুম বিল্লাহ বলেন, আমরা শুধু নামে চাকরি করি। আমাদের যে বেতন বর্তমান বাজারে তা দিয়ে কী হয়?

 

 

গ্রামপুলিশ মোঃ মাহাবুর রহমান বলেন, সরকার আমাদের যে বেতন দেয় তা দিয়ে কিছুই হয় না। তাই যতটুটু সময় পাই বাজারে পোল্টি মুরগির ব্যাবসা করি। যা পাই তা দিয়ে সংসার চলে। এই বেতন বৈষম্যের কারণে পেটের তাড়নায় গ্রামপুলিশকে বিভিন্ন ধরনের কাজ করতে হয়।

 

আরেক গ্রামপুলিশ মোঃ ইকবাল হোসেন জানান, শরীরের রক্ত বিক্রি করে সংসার চালাতে হয় তাকে।

মোঃ আব্দুল কুদ্দুস আকুন্জী বলেন আমাদের যে বেতন তা দিয়ে চলা অসম্ভব। তাছাড়া সারা দেশের নিত্য পন্যের দাম যেভাবে বেড়ে চলেছে

 

শুধু বাবু জয়দেব দফাদার মাসুম বিল্লাহ কিংবা মাহাবুর আব্দুল কুদ্দুস আকুন্জী নন, সারা দেশে গ্রাম পর্যায়ে নিয়োজিত স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অধীনে ইউনিয়ন পরিষদের নিয়ন্ত্রণে থাকা প্রায় ৪৭ হাজার গ্রামপুলিশের জীবনসংসারের গল্প প্রায় একই রকম। গ্রামাঞ্চলে গ্রামপুলিশের সদস্যদের চৌকিদার, দফাদার বা মহল্লাদার বলেও ডাকা হয়ে থাকে। গ্রামে যারা বড় হয়েছেন বা এখনও আছেন, সেসব গ্রামপুলিশ চৌকিদার শব্দের সঙ্গে পরিচিত। গ্রামের নিরাপত্তাসহ গুরুত্বপূর্ণ প্রায় সব কাজেই ডাকা হয় তাদের। তৃণমূল পর্যায়ের এই বাহিনীর ‘নীল ও খাকি’ রঙের কম্ব্যাট পোশাকও আছে। এ বাহিনীর সদস্যদের হাতে থাকে বাঁশ বা বেতের লাঠি। ইউপি চেয়ারম্যানের নির্দেশমতো কাজ করেন তারা। পাশাপাশি থানা পুলিশের গ্রামীণ পর্যায়ের যেকোনো কাজেই গ্রামপুলিশ সহযোগী হিসেবে কাজ করেন; কিন্তু তাদের তেমন কোনো ক্ষমতা নেই বললেই চলে। অনেক সময় তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যেরও শিকার হন তারা। আর সুযোগ-সুবিধাও সময় অনুসারে খুবই সামান্য, যা দিয়ে বর্তমান বাজারে চলা যায় না।

 

একাধিক গ্রামপুলিশের তথ্য অনুযায়ী, প্রত্যেক গ্রামপুলিশ সদস্য বেতন-ভাতা হিসেবে দুই খাত থেকে মোট সাড়ে ৬ হাজার টাকা পান। এর মধ্যে ৩ হাজার ২৫০ সরকারি রাজস্ব থেকে এবং বাকি ৩ হাজার ২৫০ টাকা ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) থেকে দেওয়া হয়। কিন্তু অনেক সময় ইউপি থেকে সে ভাতাটুকুও ঠিকমতো দেওয়া হয় না। ফলে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে অনেক সময় মানবেতর জীবন যাপন করতে হয়। এই গ্রামপুলিশ সদস্যদের গ্রামের মানুষের নিরাপত্তা দিতে গিয়ে নিজেদের নানা সমস্যার মুখে পড়তে হয়।

 

গ্রামপুলিশের একাধিক কর্মী দৈনিক চেতনায় বাংলাদেশ কে জানান, প্রতি ইউনিয়নে ১০ জন করে গ্রামপুলিশ নিয়োগ দেওয়া হয়, যাদের একজন থাকেন ইউনিয়ন কমান্ডার। পুলিশের পাশাপাশি থেকেই গ্রামপুলিশ কাজ করেন। তারা স্কুল-কলেজ, ইউনিয়ন পরিষদ ও উপজেলা পরিষদ পাহারা, টহলদারি, অপরাধের সব বিষয়ে অনুসন্ধান, অপরাধ দমন, অপরাধী ও অভিযুক্ত ব্যক্তিকে গ্রেফতারে পুলিশকে সহযোগিতা দেওয়া, চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালনে সহযোগিতা করা, ইউনিয়নের খারাপ ও সন্দেহভাজন লোকের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা, গ্রামে লুকিয়ে থাকা কোনো ব্যক্তি যার প্রকাশ্য রোজগার নেই তাদের খোঁজখবর করা এবং সব ধরনের নির্বাচনে দায়িত্বপালনসহ সংশ্লিষ্ট নানা কাজ করে থাকেন গ্রামপুলিশ। তাদের কাজের যে পরিধি সে তুলনায় বেতন সামান্য। এখন তাদের দাবি, গ্রামপুলিশের চাকরি জাতীয়করণ ও অবসর ভাতা চালু করা। এটা হলে অন্তত শেষ বয়সে তারা ভালো থাকবেন বলে জানিয়েছেন।

 

 

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ দৈনিক চেতনায় বাংলাদেশকে বলেছিলেন, ‘গ্রামপুলিশরা নির্ধারিত বেতন পান। তাদের উৎসব ভাতা, পোশাক, টর্চলাইট ও একটি বাইসাইকেল দেওয়া হয়। জাতীয় করনের ব্যাপারে তেমন কিছু জানান নি।

 

গ্রাম পুলিশ কর্মচারী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান কমান্ডার মোস্তফা কামাল বলেন, গ্রামপুলিশ ‘পুলিশের’ আই পাওয়ার হিসেবে কাজ করে। যেমন একটি থানার পুলিশ যে কাজ করে তার থেকেও আমরা বেশি কাজ করে থাকি। বলা যায়, একটি গ্রামের ‘এ টু জেড’ কাজ করেন গ্রামপুলিশ। কিন্তু সেদিক থেকে আমরা বেতন পাই খুবই কম। আমরা যে বেতন পাই তা একটা অফিসারের একদিনের পকেট খরচও নয়। বর্তমান বাজারে আমাদের চলতে যে পরিমাণ কষ্ট হয় তা বলে বোঝাতে পারব না। আমাদের ছেলেমেয়ের পড়াশোনা , খাওয়া দাওয়া ও চলাফেরার খরচ চালাতে পারি না। আমরা ব্যর্থ বাবা হিসেবে গণ্য হই সন্তানদের কাছে।

 

তিনি বলেন, খসড়া বিধিমালায় গ্রামপুলিশদের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের মতো বেতন স্কেল, অবসরকালীন ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার কথা উল্লেখ আছে। বিধিমালা অনুযায়ী সরকার কর্তৃক গঠিত পে-কমিশন গ্রামপুলিশদের বেতনের স্কেল সুপারিশ করে; কিন্তু ওই পর্যন্তই হয়ে আছে।

 

গ্রামপুলিশের দাবিসমূহ : বর্তমান বাজারদরের অবস্থা বিশ্লেষণ করে গ্রামপুলিশ সদস্যরা কিছু দাবি তুলে ধরেছেন। তাদের দাবি, গ্রামপুলিশের জীবনমান উন্নয়নে বাজারদরের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ বেতন দিতে হবে। একই সঙ্গে জাতীয় বেতন স্কেলের অন্তর্ভুক্ত করা, চাকরি জাতীয়করণ, সরকারি অন্যান্য বাহিনীর মতো রেশনিং ব্যবস্থা চালু, ঝুঁকি ভাতা ও চিকিৎসা ভাতার ব্যবস্থা করা। এ ছাড়া গ্রামপুলিশের জন্য ইউনিয়ন পরিষদকে প্রশাসনিক ইউনিট হিসেবে ঘোষণা করার দাবিও রয়েছে।

আরেকটি উল্লেখযোগ্য দাবি হচ্ছে- এককালীন অবসরভাতা দফাদার ৮ লাখ টাকা এবং মহল্লাদারের জন্য ৭ লাখ টাকা নির্ধারণ করা।

Author

আরও খবর

                   

জনপ্রিয় সংবাদ