অন্যান্য

চুকনগর গণহত্যা দিবস: ইতিহাসের নির্মমতম অধ্যায়

  প্রতিনিধি 20 May 2025 , 8:30:23 প্রিন্ট সংস্করণ

বিশেষ প্রতিবেদন

আজ ২০ মে, ইতিহাসের এক বিভীষিকাময় দিন—চুকনগর গণহত্যা দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার চুকনগরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মাত্র কয়েক ঘণ্টায় গুলি চালিয়ে ৮ থেকে ৯ হাজার নিরীহ মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করে।

বিশ্বের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং গণহত্যার ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, স্বল্প সময়ের মধ্যে সংঘটিত এই গণহত্যাটি বিশ্বের সবচেয়ে ভয়াবহ ও জনবহুল গণহত্যার একটি। এর নিষ্ঠুরতা ও ভয়াবহতা এতটাই বেশি ছিল যে, একে ‘পূর্ব বাংলার জালিয়ানওয়ালাবাগ’ বলা হয়ে থাকে।

যেভাবে সংঘটিত হয় নারকীয় হত্যাযজ্ঞ

১৯৭১ সালে মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে খুলনার বাগেরহাট, রামপাল, মোড়েলগঞ্জ, কচুয়া, শরণখোলা, মংলা, দাকোপ, বটিয়াঘাটা, ডুমুরিয়া, চালনা অঞ্চলের হাজার হাজার মানুষ ভারত অভিমুখে পালাতে শুরু করে। তারা চুকনগর হয়ে সাতক্ষীরা সীমান্ত দিয়ে ভারতে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিল।

১৯ মে রাতেই প্রায় ৮–১০ হাজার মানুষ চুকনগরের বিভিন্ন এলাকায়—পাতোখোলা বিল, কাঁচাবাজার, মাছবাজার, কাপুড়িয়া পট্টি, গরুহাটা ও কালী মন্দির এলাকায় আশ্রয় নেয়। তারা ধারণা করেছিল ভোরবেলা নিরাপদে ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা হতে পারবে।

কিন্তু ২০ মে সকালে রান্নাবান্না ও খাওয়া-দাওয়ার সময়ই পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি ট্রাক ও একটি জিপ চুকনগর-সাতক্ষীরা সড়কে এসে মালতিয়া মোড়ের ঝাউতলায় থামে। স্থানীয় এক বৃদ্ধ, চিকন আলী মোড়ল, গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রথম শহীদ হন। পরে একই গ্রামের সুরেন্দ্রনাথ কুন্ডুকেও হত্যা করা হয়।

এরপর পাক সেনারা বাজারজুড়ে ব্রাশ ফায়ার শুরু করে। নারী, শিশু, বৃদ্ধ কেউই রেহাই পায়নি। তিন ঘণ্টার মধ্যে পুরো চুকনগর রূপ নেয় এক মরণপুরীতে।

নৃশংসতার রূপ

ঘটনার ভয়াবহতায় অনেক শিশু পায়ের নিচে পিষ্ট হয়ে মারা যায়। মায়েরা সন্তানদের ফেলে প্রাণ বাঁচাতে দৌড়ায়, কেউ বাঁচতে পারেনি। মৃত মায়ের বুকে শুয়ে শিশুর স্তন পান করার দৃশ্য হৃদয়বিদারক স্মৃতি হয়ে রয়ে গেছে।

চুকনগরের ধুলোমাটির রং লাল হয়ে ওঠে রক্তে। ভদ্রা নদী হয়ে ওঠে লাশের বহর। বাজারের অলিগলি, মন্দির, বিল সবখানেই শুধু মৃতদেহ আর রক্ত। শকুন-কুকুর টানাটানি করে মৃত ও মৃতপ্রায়দের লাশ।

স্মৃতির সংরক্ষণ ও অবহেলা

২০০৫ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার চুকনগরের পাতোখোলা বিলে ৮৫ শতক জমি অধিগ্রহণ করে বধ্যভূমি নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। তখন বলা হয়েছিল, এটি পর্যায়ক্রমে পর্যটন কেন্দ্রে রূপান্তরিত হবে।

কিন্তু ২০০৬ সালে সরকারের মেয়াদ শেষে প্রকল্পটি থেমে যায়। এরপর ওয়ান ইলেভেন এবং ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকার ১৭ বছর ক্ষমতায় থেকেও সেই বধ্যভূমিতে কোনো দৃশ্যমান উন্নয়ন করেনি।

বছরের পর বছর সরকার ও রাষ্ট্রীয় উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তিরা এই জায়গা ঘুরে গেছেন, মঞ্চে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, পত্রিকায় ছাপা হয়েছে বড় বড় কথা—কিন্তু বাস্তবে কাজ হয়নি কিছুই। এমনকি একবার ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রদূত হর্ষ বর্ধন শিংলাও বলেছিলেন, এই গণহত্যা স্মৃতিস্তম্ভ আধুনিকায়নে ভারতও সহযোগিতা করবে—তবু উদ্যোগের বাস্তবায়ন হয়নি।

আজকের প্রেক্ষাপট

বিশেষজ্ঞরা বলেন, এই গণহত্যা শুধু খুলনা বা চুকনগরের নয়—এটি গোটা বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি ভয়াল অধ্যায়। এটি ছিল পূর্ব বাংলার মানুষকে ধ্বংসের পরিকল্পিত অংশ। অথচ এতবড় ঘটনার স্মৃতিচিহ্ন আজও পড়ে আছে অযত্ন-অবহেলায়।

চুকনগর গণহত্যা দিবসে নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের সত্য ও ইতিহাস তুলে ধরার দাবি ওঠেছে। পাশাপাশি, এই বধ্যভূমিকে যথাযোগ্য মর্যাদায় সংরক্ষণ ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি আদায়ের আহ্বান জানিয়েছেন সচেতন মহল।

আরও খবর

                   

জনপ্রিয় সংবাদ